ঈদে আকাশপথে বাড়িফেরার টিকিট উধাও। বিমান, ইউএস-বাংলা ও নভোএয়ারের কাউন্টারে ঈদের আগের ১০ দিনের অগ্রিম টিকিট নেই। এখন কিছু টিকিট পাওয়া গেলেও সেগুলোর দাম সর্বোচ্চ ধাপের। প্রতিটি এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম চার থেকে পাঁচ ধাপে নির্ধারণ করা হয়।
আটাবের (অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ) একজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো কোনো রুটে ঈদের অগ্রিম টিকিট শেষ হয়ে গেছে। দু-একদিনের মধ্যে সর্বোচ্চ ধাপের টিকিটও পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ ঢাকা থকে চট্টগ্রাম যাওয়া একজন যাত্রী আগে সর্বনিম্ন ২৫শ থেকে ৩ হাজার টাকায় টিকিট পেলেও এখন তাকে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি দামে অগ্রিম টিকিট কাটতে হচ্ছে। যতই দিন যাবে, এই দাম বাড়তে থাকবে।
এই চিত্র দেশের অভ্যন্তরীণ রুটের। আন্তর্জাতিক গন্তেব্যেও একই চিত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতের বিভিন্ন রুটে ঈদের অগ্রিম টিকিট নিয়ে হাহাকার চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এখন পর্যন্ত এ রুটগুলোয় কিছু কিছু টিকিট পাওয়া গেলেও ঈদের ১০ দিন আগের কোনো টিকিট নেই। অভিযোগ উঠেছে এয়ারলাইন্স মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশে ট্রাভেল এজেন্টগুলোর একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই সময়ের অধিকাংশ আন্তর্জাতিক গন্তেব্যের টিকিট ব্লক করে রেখেছে। তাদের টার্গেট সংকট তৈরি করে যাত্রী চাহিদা বাড়িয়ে প্রতিটি টিকিট চার-পাঁচগুণ বেশি দামে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া।
বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ার বিমানসহ মোট ৩টি এয়ারলাইন্স যাত্রী পরিবহণ করছে। বাকি দুটি হলো ইউএস-বাংলা ও নভোএয়ার। এই ৩টি এয়ারলাইন্স প্রতিদিন গড়ে ৭টি অভ্যন্তরীণ রুটে ৭৫ থেকে ৮৫টি ফ্লাইট অপারেট করছে। সবচেয়ে বেশি ফ্লাইট করছে ইউএস-বাংলা ৩৫টি। এরপর নভো এয়ার ২৫টি, বিমান ২০ থেকে ২৫টি। অভ্যন্তরীণ রুটে বেশির ভাগ এয়ারলাইন্স ৭২ থেকে ৭৮ আসনবিশিষ্ট ছোট এয়ারক্রাফট দিয়ে যাত্রী পরিবহণ করছে। তবে বিমান ও ইউএস-বাংলা কিছু কিছু ফ্লাইট অপারেট করছে ১২৫ এর বেশি আসনবিশিষ্ট বোয়িং ৭৩৭ মডেলের এয়ারক্রাফট দিয়ে। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন ৩টি এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে সাড়ে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার পর্যন্ত যাত্রী পরিবহণ করছে। ঈদের আগে কিছু কিছু রুটে অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করলে আরও ১ হাজার যাত্রী বাড়ার কথা রয়েছে। এই হিসাবে ঈদের ১০ দিন আগে থেকে আকাশপথে মোট ৮০ হাজার যাত্রী ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে। আবার সমপরিমাণ যাত্রী ঢাকায় ফিরবে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের জেনারেল ম্যানেজার (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম জানান, তার জানামতে অনেক রুটে ঈদের অগ্রিম টিকিট শেষ। এখন সবচেয়ে বেশি দামের টিকিট বিক্রি চলছে। তার মতে, এবার ঈদে বাসে ভয়াবহ যানজট হতে পারে। ট্রেনের টিকিট পাবেন না অনেক যাত্রী। লঞ্চের চিত্রও হবে ভয়াবহ। তাছাড়া ২ বছর ধরে মানুষ বাড়ি যেতে পারছে না। এ কারণে আগেভাগে যারা বাড়ি যাবেন, তারা আকাশপথের টিকিটের জন্য হন্য হয়ে ছুটছেন। তিনি বলেন, রোজার প্রথম দিন থেকে ঈদযাত্রার অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে।
আন্তর্জাতিক গন্তব্যের মধ্যে আকাশপথে ভারতে যাওয়ার টিকিট নিয়ে এখনো নৈরাজ্য কাটেনি। স্থলপথে যাত্রী পরিবহণ শুরু হলেও এই রুটে আকাশপথের চিত্র আগের মতো। উলটো একটি বিদেশি এয়ারলাইন্স এখনো আকাশচুম্বী ভাড়া আদায় করে যাচ্ছে। একই অবস্থা চলছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি রুটেও।
আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে চীনের বিভিন্ন গন্তব্যে আগস্ট পর্যন্ত কোনো আসন খালি নেই। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সপ্তাহে একটি ফ্লাইট করছে। ওই ফ্লাইটে শুধু চীনের নাগরিকদের পরিবহণ করা হচ্ছে। তারপরও আগস্ট পর্যন্ত কোনো আসন খালি নেই। যাত্রীদের অভিযোগ, কোনো কারণ ছাড়া বিমান সংস্থাগুলোর একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এখনো ভারতের বিভিন্ন রুটে ভাড়া হাঁকাচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। ভারতের সব রুটে ভাড়া বেড়েছে ৩-৪ গুণ বেশি। রোববার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ঢাকা-চেন্নাই সরাসরি রুটে একটি টিকিট বিক্রি করেছে (১৩ এপ্রিলের) ২০ হাজার টাকা, সেখানে ভারতীয় বিমান সংস্থা ইন্ডিগো সে টিকিট বিক্রি করছে ৩২ হাজার টাকা। ইন্ডিগোর স্থানীয় সেলস অফিস সূত্রে জানা যায়, এই টিকিট যদি যাত্রার এক দিন আগে ক্রয় করে, তাহলে দাম পড়বে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, ঈদের আগে ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-দিল্লি ও ঢাকা-চেন্নায় রুটে টিকিটের দামফের ৬০-৭০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যাত্রার এক সপ্তাহ আগে টিকিট না কাটলে দাম পড়ে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এই অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েছেন ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া যাত্রীরা।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, রাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে বন্ধ থাকায় ফ্লাইট সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এ কারণে যাত্রী চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি জানান, আকাশপথের টিকিট নিয়ে সংকট কাটানোর জন্য তারা একাধিকবার বিভিন্ন এয়ারলাইন্স সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও এই নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ টিকিটের মূল্য না কমালে এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। তারপরও এই সংকট কাটেনি। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে তারা রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ার বিমানের জন্য একটি সিলিং করে দিয়েছেন। এর বাইরে আর দাম বাড়ানো যাবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন অনুযায়ী আমরা কোনো এয়ারলাইন্সকে বাধ্য করাতে পারি না। আমরা অনুরোধ করতে পারি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী মে মাস থেকে রাতে ফ্লাইট খুলে দেওয়া হবে। তখন আর এই সংকট থাকবে না। তার মতে, ইতোমধ্যে সংকট কমতে শুরু করেছে।
মিজানুর রহমান নামে এক যাত্রী জানান, তিনি বৃহস্পতিবার আকাশপথে ভারত যাওয়ার ভিসা পেয়েছেন। আজ তার চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনো এয়ারলাইন্সে টিকিট নেই। ইন্ডিগো একটি টিকিটের জন্য দাম চেয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। শেষ পর্যন্ত তিনি যাত্রার তারিখ এক সপ্তাহ পিছিয়ে এবং ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স থেকে ওই টিকিট কেটেছেন ২০ হাজার টাকায়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আগামী ঈদকে কেন্দ্র করে এই রুটগুলোয় ভাড়া নিয়ে চরম অরাজকতা হবে। অভ্যন্তরীণ রুট ও ভারতসহ আন্তর্জাতিক সব রুটে ইতোমধ্যে ঈদের ১০ দিন আগের সর্বনিম্ন ক্লাসগুলোর টিকিট বিক্রি শেষ। বিমান সংস্থাগুলো জানিয়েছে, একটি রুটে টিকিটির মূল্য চার থেকে পাঁচ ধাপে নির্ধারণ করা হয়। যেমন: ঢাকা-চট্টগ্রামের সর্বনিম্ন ধাপের টিকিটের দাম সাড়ে ৩ হাজার টাকা। অপরদিকে সর্বোচ্চ ধাপের টিকিটের দাম ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। চাহিদা বেশি হলে সর্বোচ্চ ধাপ ২০ হাজার টাকায়ও চলে যায়। অর্থাৎ ভ্রমণের তারিখ যতই কাছে আসবে, ততই মূল্যের এই ধাপ বাড়তে থাকবে।
এদিকে আগামী মে পর্যন্ত সৌদি আরবের টিকিট নেই ট্রাভেল এজেন্টগুলোর কাছে। সরাসরি এয়ারলাইন্সগুলোকে এ রুটের ভাড়া দিতে হয় ২ গুণ বেশি। ৪০ হাজার টাকা ঢাকা-রিয়াদ রুটের বিমান ভাড়া এখন ৯২ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। তাও মিলছে না। ৪৫ হাজার টাকার ঢাকা-দুবাইয়ের রিটার্ন ভাড়া এখন ৯০ হাজার থেকে ৯৫ হাজার টাকা। ঈদের ১০ দিন আগে এসব রুটে টিকিট নিয়ে বড় ধরনের অরাজকতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব রুটের ভাড়া নিয়ে এভাবে চলছে অরাজকতা। চিকিৎসা ও স্টুডেন্ট ভিসাধারী ভারতগামী যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। একদিকে টিকিট নেই, অপরদিকে টিকিটের দাম চার-পাঁচগুণ বেশি।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শল এম মফিদুর রহমান বলেছেন, এভাবে কোনো কারণ ছাড়া আকাশপথের ভাড়া বৃদ্ধির ঘটনা দুঃখজনক। তিনি বলেন, কমার্শিয়াল ইস্যুতে বেবিচকের হস্তক্ষেপ করার তেমন সুযোগ নেই। তারপরও আমরা এয়ারলাইন্সগুলোকে ডেকে ভাড়া কমানোর নির্দেশ দিয়েছি। কারণ নেপাল, ভারত, পাকিস্তানসহ আশপাশের কোনো দেশ থেকে অন্য আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান ভাড়া বাড়েনি। শুধু ঢাকা থেকে কেন এত ভাড়া বাড়বে? এমন যুক্তি দেখিয়ে কৈফিয়ত চাওয়ার পরও তারা কোনো সাড়া দেয়নি। সুত্র: যুগান্তর।
ভিন্নবার্তা ডটকম/এসএস