আমাদের দেশের চলচ্চিত্র সমাজের জন্য ভালো মেসেজ দিচ্ছে না। এ কারণে এখন রুচিশীল দর্শকরা বাংলা সিনেমা দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। আর সিনেমা হলে যাওয়া মানুষ তো একেবারেই নেই বললেই চলে। চোখের সামনেই অনেক সিনেমা হল বন্ধ পড়ে আছে। আর যেসব সিনেমা তৈরি হচ্ছে, তাতে নতুন কিছু নেই। আছে বিনোদনের নামে অশ্লীলতা, যৌনতা। অনেক সিনেমায়ই যৌন আবেদনে ভরপুর। একই কাহিনী দিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বার বার চিত্রায়িত করা হচ্ছে। এসব দৃশ্য আমাদের দর্শকরা দেখতে চান না। একান্ত যারা দেখছেন, তারা এই সিনেমা থেকে নানা অপরাধ শিখছেন। এসব দেখে সমাজে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন তারা। খোদ চলচ্চিত্র পরিচালক ও সিনেমা মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম কিরণ বলছেন, আমাদের চলচ্চিত্র এখন অসুস্থ। সিনেমা দেখে মানুষ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা দেখে দর্শকরা ধর্ষণ শিখছে।
চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবসরেই মনের পুষ্টি, অবসরেই মনের স্ফুরণ। কিন্তু তার জন্য অবসরও হতে হবে অর্থময়। জীবনের তীব্র প্রতিযোগিতাময় অনিশ্চয়তা অবসরেও থাকার সময় পান না অনেকে। যে কারণে আমাদের ভবিষ্যৎই অসম্ভব এক ঝুঁকির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। নানা জরিপে এমন আশঙ্কার তৈরি হয়েছে। যারা অবসর পান, তারা ওই সময়টুকু বিনোদনে কাটাতে চান। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্র আমাদের বিনোদন না দিয়ে অশ্লীলতা শেখাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, ‘চলচ্চিত্র স্বপ্নের মতো, সঙ্গীতের মতো। আর কোনো শিল্পই চলচ্চিত্রের মতো করে আমাদের চেতনার বাড়িতে হানা দিতে পারে না। চলচ্চিত্র আমাদের অনুভূতিতে, আমাদের আত্মার আধার কুঠুরিতে ঠিকই সরাসরি ঢুকে পড়ে। তবে তা এখন আর ইতিবাচকভাবে নয়, ঢুকছে ঠিকই তা নেতিবাচকভাবেই। ফলে মানুষের হৃদয় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের এফডিসিতে কোনো পড়াশোনা নেই। একটি পাঠাগার আছে। কিছু বই যা আছে, সেগুলো শুধু সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য। কেউ সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখার জন্যও নাকি ধরেন না। ধরবেন কীভাবে, সারা দেশেই পড়ালেখার প্রতি অনীহা রয়েছে। এ কারণেই চলচ্চিত্র বিষয়ক সাহিত্য যেমন অবহেলিত, তেমনি উপেক্ষিত যারা চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করেন। তবে সরকারিভাবে এই চলচ্চিত্র সাহিত্যকে গুরুত্ব দিলে চলচ্চিত্রে ভালো কিছু পাওয়া যেত। নানা কারণেই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ পরিচালক শাহ আলম কিরণ বলছিলেন, আমাদের চলচ্চিত্রটাই অসুস্থ হয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি, আবার ঠিক করার জন্য। অশ্লীলতা সিনেমার পারিবারিক দর্শকদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর এসব দেখেই রাস্তাঘাটে রেপ (ধর্ষণ) হচ্ছে। সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা দর্শকদের পর্দায় আড়াই ঘণ্টা ধরে রাখতে পারি না এ কারণে। ভালো শিল্পী, ভালো দর্শক নেই সিনেমায়।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের একটি বড় জগৎ বাণিজ্যিকজগৎ। এই জগতে বিরাজ করেন বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীরা। তাঁদের ছবি বাইরের দেশে উৎসবে যায় না। দেশের প্রেক্ষাগৃহই তাঁদের একমাত্র ভরসা। এই শিল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। এই মানুষগুলো বিভিন্ন সমিতিও গঠন করেছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন বা বিএফডিসির ভেতরে। প্রযোজক, পরিচালক, সহকারী পরিচালক ও শিল্পীদের এসব সমিতি যেহেতু ‘উন্নয়নের জন্য গঠিত হয়েছে, তাই ধরে নেয়া যায় চলচ্চিত্রের উন্নয়নই হওয়া উচিত তাঁদের অন্যতম লক্ষ। পরিতাপের বিষয়, আমরা জানতে পারি তাঁরা শুধু নির্বাচন, আলোচনা সভা ও বনভোজনেই সীমাবদ্ধ থাকেন। এফডিসিতে দেখা যাচ্ছে দুই-তিনটি কাজ বাদে চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তেমন কোনো কাজ সমিতিগুলো করছে না। ভালো সিনেমা নির্মাণে কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও দেশব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী হতে পারে। সুষ্ঠু ধারার সিনেমা বানাতে বাধ্য করতে পারে সেন্সর বোর্ড। কিন্তু না, তারা দু’একটি সিনেমার নানা দৃশ্য কাটছাঁট করে, আবার নানা সুবিধা গ্রহণে অশ্লীল দৃশ্যসংবলিত সিনেমাও মুক্তি দিয়ে দিচ্ছে।
টার্গেট লগ্নির কয়েকগুণ ঘরে তোলা
এখন নাটক-সিনেমার সঙ্গে জড়িত অনেকেই মনে করছেন, আসলে এখন কোনো জ্ঞানের চর্চা হচ্ছে না। বরং বিকৃত অনেক কিছুই ঘটছে, যা সচেতন মানুষ গ্রহণ করছেন না। বেশিরভাগ সিনেমার ভাষা খুই অশ্রাব্য। বিকৃত বাংলা ব্যবহার করা হয় সংলাপে। আঞ্চলিক ভাষার দোহাই দিয়ে এসব ব্যবহার করা হয় অহরহ। অথচ পরিচালক চাইলে পুরো গল্প বা কাহিনীতেই একেবারেই শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। সিনেমার কোনো কোনো সংলাপ অংশে এমন সব শব্দ উচ্চারণ করা হয়ে থাকে, যেসব শব্দ শুনতে কেউ আগ্রহী নন। ফলে এরও বিরূপ প্রভাব পড়ে সমাজে। কেননা যারা এই সিনেমা দেখছেন, তারা এসব ডায়ালগ মুখস্থ করেন। পরে বাস্তব জীবনে নানা ছলে তা প্রয়োগ করেন। এতে সমাজে এসব অশ্রাব্য শব্দ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
পরিকল্পিত আগ্রাসন
আমাদের সমাজের যারা সিনেমা হলে যান না বা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন না, তারা কিন্তু ঘরে একেবারেই বসে নেই। নারীরা; বিশেষ করে যারা গৃহিণী, তারা অবসর পেলে রিমোট হাতে নিয়ে বসে পড়েন টেলিভিশনের সামনে। পর্দায় কিছু না কিছু দেখেন। একথা মোটামুটি সবার জানা আছে যে, ঘরে থাকা বধূরা সিরিয়াল বেশি দেখেন, তাও আবার বিদেশি সিরিয়াল। এসব দেখে সিরিয়ালের কাহিনী অনুকরণে দেশে বিভিন্ন সময় নানা অপরাধ হয় বলে গণমাধ্যমে খবরও বের হয়েছিল। তাছাড়া ভারতের কোনো এক সিরিয়ালের অভিনেত্রীর পোশাক অনুকরণে তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা ‘পাখি ড্রেস’ তৈরি করেন এবং বাংলাদেশের অনেকেই এই ড্রেস কেনেন ও পরেন। এ খবর সকলেরই জানা আছে, পাখি ড্রেস কেনা হয়নি বলে অনেকের সংসার থেকে বৌ চলে গেছে। ছোট্ট অবুঝ কিশোরীরা এই ড্রেস না পেয়ে আত্মহননের পথও বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে শহরের বন্দী ঘরে থাকা শিশুরাও কোনো না কোনো চলচ্চিত্র দেখে। বিশেষ করে শিশুরা বেশি দেখেন হিন্দি ও ইংলিশ মুভি। মোটামুটি সাধারণ পরিবার থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে অনেক শিশুই হিন্দি ভাষা বলতে পারে এবং বিদেশি শব্দের বেশিরভাগই এরা শিখেছে বিদেশি চলচ্চিত্র থেকে। এটাকে ভাষাগত আগ্রাসন বলছেন বিশ্লেষকরা।
সিনেমার দৃশ্যে কি থাকছে
একসময় সিনেমা হলে নতুন সিনেমা এলে হল মালিকরা এলাকায় মাইকিং করে জানাতেন নতুন সিনেমা এসেছে। ওই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম ও সিনেমার পরিচালকদের নামও প্রচার করা হতো। এসব প্রচার মাইকে একটি কমন বিষয় তারা বলতেন। তা হচ্ছে- ‘পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মতো ছবি’। কিন্তু এখন আর সেই কথা বলা হয় না। কারণ হল মালিকরা নিজেরাও জানেন, এই সিনেমা পরিবারের সকলে মিলে দেখা যাবে না। অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয় করতে অনেকেই বাধ্য হন বলে অভিযোগ নায়ক-নায়িকা ও খলনায়ক-নায়িকাদের। দেশের এমন সিনেমা খুঁজে পাওয়া দায়, যে সিনেমায় নায়ক-নায়িকা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছেন না। এসব দেখে আমাদের তরুণ-তরুণীরা অপরাধে উদ্বুদ্ধ হন। চলে যান বিপথে। খোদ এক চলচ্চিত্র পরিচালক নিজেই বলেছেন, এখন আমরা সিনেমায় যা দেখাচ্ছি, তা দেখে একজন দর্শকের মন-মানসিকতা নষ্ট হচ্ছে। কিছু কিছু দৃশ্য পুরো সমাজের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ভিলেনের চরিত্রে কী মেসেজ দেওয়া হচ্ছে
সিনেমায় অশ্লীলতা বন্ধে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। কিন্তু অশ্লীলতা বন্ধ হচ্ছে না। বিশেষ করে ভিলেনের চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন, তাকে দুশ্চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। তাকে ধর্ষক-খুনি, মাস্তান ও চাঁদাবাজ হিসেবে অভিনয় করতে হয়। কিন্তু অনেক সিনেমায়ই এই ভিলেনের পোশাক নির্ধারণ করা হয় সমাজের সাধারণ মানুষকে ভিন্ন মেসেজ দিতে। তা হচ্ছে- একসময়ের প্রভাবশালী খলনায়ক চরিত্রের অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, হুমায়ুন ফরিদিসহ বড় অভিনেতাদের পায়জমা, পাঞ্জাবি, টুপি ও দাড়ি পরিয়ে অভিনয় করতে বাধ্য করেছেন পরিচালকরা। ওইসব সিনেমার পরিচালকরা খলনায়কদের এই পোশাক নির্ধারণ করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এই মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যে, এই টুপি-দাড়িওয়ালা লোকগুলো সমাজের খারাপ চরিত্রের লোক। সংশ্লিষ্ট পরিচালকরা ইসলাম ও মুসলমানদের চরিত্র হননের এই ষড়যন্ত্রে সফলও হয়েছেন।
যেসব দৃশ্য না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই
একাধিক সিনেমা দর্শকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা বলছিলেন, সিনেমায় তারা কোনো অশ্লীল দৃশ্য দেখতে চান না। তারা চান পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখা যায়, এমন শিক্ষণীয় কোনো গল্প নিয়ে সিনেমা তৈরি হোক। এতে নায়ক-নায়িকা থাকবে, তবে গল্প হবে শিক্ষণীয় ও বিনোদনমূলক আর অভিনয় হবে দৃষ্টিনন্দন। তারা বলছেন, ভিলেন কর্তৃক নায়িকাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে এমন দৃশ্য না থাকলে কি সিনেমা হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, কথায় কথায়ই সিনেমায় ফাইটিং হচ্ছে। অথচ বিশ^জুড়ে এমন হাজার হাজার সিনেমা রয়েছে, যেখানে কোনো একটি মারামারি নেই। কিন্তু আমাদের সিনেমায় মারামারি, গোলাগুলি, বোমাবাজি, ভাঙচুর ছাড়া যেন জমেই না। এসব দৃশ্যে শেখার কিছুই নেই, সময় অপচয় ছাড়া। তাছাড়া এগুলো দেখলে দর্শকদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়, ফলে তারা বাস্তব জীবনে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে ধ্বংস হচ্ছে সমাজ।
ভিন্নবার্তা ডটকম/এসএস