তরুণ ও শিশুরা নানা কারণে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিশেষ করে অবাধ সোশ্যাল মিডিয়া তরুণ শিক্ষার্থীদের বই থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। শিক্ষার্থীদের নেশা এখন ইন্টারনেটে অ্যাপ, গেম, ভিডিও, চ্যাটিং, টিকটকে। ফলে তারা বিদ্যাচর্চার বদলে পথ হারিয়ে হেরোইন, গাঁজা, মদেও আসক্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে শিশুদের ফেরাতে তেমন কোনো কার্যকরী উদ্যোগ সরকারের হাতে না থাকায় উদ্বেগ বাড়ছে অভিভাবক মহলে। বেসরকারি পর্যায়েও অবাধ প্রযুক্তি থেকে শিশুদের ফেরানোর প্রয়োজনীয় কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে আগামী প্রজন্ম কোন দিকে যাচ্ছে, সহজেই তা অনুমেয়। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার আগের ও পরের শিক্ষার্থীদের মনঃসংযোগে বিশাল ফারাক বলছেন শিক্ষকরা। আগের তুলনায় এখনকার শিক্ষার্থীরা ক্লাসে কম মনোযোগী। কারণ কী? ইন্টারনেট। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ফেসবুক; পলকে পলকে যেখানে নতুন তথ্য, নতুন ছবি ভেসে বেড়ায়। কোনো কিছুতেই বইয়ে মনোযোগ দেওয়ার অবকাশ নেই। ভার্চুয়াল এই অভ্যাস বাস্তবেও প্রভাব ফেলছে।
৯ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর অধিকাংশই তরুণ
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটির অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিইউ টুডে-তে একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। তাতে শিক্ষার্থীদের একটি চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছিল। ১৫ মিনিট সামনে ফোন রেখে বসে থাকতে হবে, কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু সামনে ফোন রেখে সব শিক্ষার্থীই এমন উসখুস করতে থাকলেনÑ যেন কোনো ভয়ানক নেশাদ্রব্যের অভাব বোধ করছেন! ব্যাপারটি আসলে নেশার মতোই হয়ে গেছে। ২০১৭ সালে গ্লোবাল ডিজিটাল স্ট্যাটশট অব কিউটুর প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকে সক্রিয় ব্যবহারকারীর মধ্যে ঢাকা শহর দ্বিতীয়। জরিপ চালানোর সময় দেখা যায়, ঢাকায় এক মাসে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ২০ লাখ। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৯ কোটি ১৪ লাখ ২১ হাজার মানুষ। এর মধ্যে অধিকাংশই যে তরুণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তরুণদের বেশিরভাগই আবার শিক্ষার্থী, এতেও দ্বিমতের অবকাশ নেই। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির প্রকাশনা সংস্থা এমআইটি প্রেস একটি গবেষণাগ্রন্থ বের করেছে। বিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যাডাম গ্যাজালি ও মনোবিজ্ঞানী ল্যারি ডি. রোজেনের লেখা বইটির নাম দ্য ডিসট্র্যাকটেড মাইন্ড: অ্যানসিয়েন্ট ব্রেইনস ইন আ হাই-টেক ওয়ার্ল্ড। বিপুল পাঠকপ্রিয় এই বইয়ে বলা হয়েছে, দোষ ইন্টারনেট বা স্মার্টফোনের নয়, সমস্যা আমাদের মস্তিষ্কে।
দিনে ১৫০ বার ফোনে দৃষ্টি দেয় মানুষ
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ এখন প্রতিদিন গড়ে ১৫০ বার ফোন খুলে দেখে। এই তাড়না কাজ করে প্রতি ৬-৭ মিনিট পরপর। ক্রিকেট ম্যাচে ব্যাটসম্যান ভুল শট খেলে আউট হলে ধারাভাষ্যকাররা প্রায়ই বলেন, ‘মনঃসংযোগে চিড় ধরায় ভুল শটটি খেললেন অমুক’। ঠিক একইভাবে চেতনে-অবচেতনে প্রযুক্তিতে ডুবে থাকা অসংখ্য তরুণ প্রতিদিন অনেক কাজেই ‘ভুল শট’ খেলছেন। আবার প্রযুক্তি থেকে দূরে সরে থাকাও এখন অসম্ভব বোকামি। এমনটাই বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক বিএম মইনুল হোসেন, ‘প্রযুক্তির অপব্যবহার না করলে কোনো সমস্যা নেই। আসক্তি হয়ে গেলেই সমস্যা। তাই সহজ সমাধান হলো, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় ফোন, ইন্টারনেট দূরে রাখা। অন থাকলেই নোটিফিকেশন আসবে, মনোযোগে চিড় ধরবে।’
মোবাইল নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করছে
মোবাইলের অপব্যবহার দেশের নতুন প্রজন্মকে যেন ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একসময় লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের মেধার বিকাশ ঘটত। এখন লাখ লাখ কম বয়সী ছেলেমেয়ের দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে মোবাইলে গেম খেলে। হাট-মাঠ-ঘাট, রাস্তার মোড়, গলিপথ; এমনকি বাসাবাড়িতেও দেখা যায় নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, গেম খেলেন। ছেলেমেয়েরা মোবাইলে আসক্ত হওয়ায় পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে সম্পর্ক গড়ে ওঠা, এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে পরস্পরের দেখা-সাক্ষাৎ কমে গেছে। সামাজিক বন্ধন আলগা হচ্ছে মোবাইল গেমে সময় কাটানোয়। বৈশ্বিক মহামারি করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৫ মাস ধরে বন্ধ থাকায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসাপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের মোবাইলে সময় কাটানো আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা মোবাইলে আসক্ত যে ছেলেমেয়েরা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে; আগামীতে দেশ গড়তে তাদের মস্তিষ্ক কি স্বাভাবিকভাবে কাজ করবে? তাদের মতে, মোবাইল ব্যবহার করে টিকটক বানিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়া, গেম নেশায় আশক্ত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। এখন এর প্রভাব বোঝা না গেলেও কয়েক বছর পর নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হয়ে ধরা দেবে।
ইন্টারনেট গেম নেশার মতো
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল গণমাধ্যমকে বলেন, মোবাইলে ইন্টারনেট গেম আসক্তি অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্য ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, মদ ইত্যাদি আসক্তির মতোই। পার্থক্য হচ্ছেÑ এটি আচরণগত আসক্তি, আর অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি, রাসায়নিক আসক্তি। মস্তিষ্কের যে অংশে (রিওয়ার্ড সেন্টার) ইয়াবা বা গাঁজার মতো বস্তুর প্রতি আসক্তি জন্ম নেয়, ঠিক সেই অংশেই কিন্তু ইন্টারনেট বা গেমের প্রতি আসক্তি জন্মায়। তাই একে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। এটা থেকে সন্তানদের দূরে রাখতে পরিবারকে সতর্ক হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপারসন প্রফেসর ড. আবুল মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, পিতা-মাতাকে সন্তানদের সময় দিতে হবে। সন্তানদের পড়াশোনায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। সর্বোপরি সন্তান যাতে মোবাইল ডিভাইসে আসক্ত হয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সাইবার ক্যাফেগুলোও ছড়াচ্ছে অস্থিরতা
খবর নিয়ে জানা গেছে, দেশের প্রতিটি জেলায় গড়ে ওঠা সাইবার ক্যাফেগুলোর প্রযুক্তির অপব্যবহার প্রশ্নের সম্মুখীন। স্কুল-কলেজ-মাদরাসাগামী শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সাইবার ক্যাফেতে গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কলেজপড়ুয়ারা অশ্লীল সাইটগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। দেশে এমনিতেই অসামাজিক কর্মকাণ্ড যে ঘটে না তা নয়। তবে মোবাইলের অপব্যবহারে ইদানীং বেশি ঘটছে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ১৫ মাসে অন্তত ১৫১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ২৯ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের বেশিরভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। গত বছরের ১৮ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকে গত ৪ জুন পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ভিন্নবার্তা ডটকম/এসএস