
মোস্তাফিজুর রহমান তারা, রৌমারী (কুড়িগ্রাম): আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কুড়িগ্রাম-৪ সংসদীয় আসনে বিরল এক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ আসনে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামী—দু’দলের প্রার্থী দুইজনই আপন ভাই। ফলে এই দুই ভাইয়ের মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটাররা পড়েছেন চরম সিদ্ধান্তহীনতায়।
কুড়িগ্রাম-৪ আসনটি রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী এই তিন উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত। দীর্ঘদিন ধরেই এ আসনটি বিএনপি ও জামায়াত—উভয় দলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
৫ আগস্টের পর জামায়াতে ইসলামী দ্রুত সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাককে কুড়িগ্রাম-৪ আসনে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয়। ঘোষণার পর থেকেই তিনি মাঠে নেমে পড়েন, তৃণমূল পর্যায়ে মতবিনিময়, উঠান বৈঠক ও কর্মীসভা করে ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা কিছুটা বিলম্বিত হয়। অবশেষে অদ্য ৩ নভেম্বর ২০২৫, সোমবার দলটির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশান দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ২৩৮টি আসনে বিএনপির প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ তালিকায় কুড়িগ্রাম-৪ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন পান মোস্তাকের আপন বড় ভাই আলহাজ্ব আজিজুর রহমান।
খবরটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর জুড়ে। ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাজারের মোড়, এমনকি গ্রামের হাটেও এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু—দুই ভাইয়ের নির্বাচনী লড়াই।
আলহাজ্ব আজিজুর রহমান ২০১৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় বিএনপির মনোনীত প্রার্থীদের ওপর নানা বাধা ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভোটের দিন সকাল থেকেই বিএনপি সমর্থকরা কেন্দ্র দখল, মারধর ও গ্রেফতারের আতঙ্কে ভোট দিতে পারেননি। মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে আজিজুর রহমান প্রায় ৭০ হাজার ভোট পান, কিন্তু পরবর্তীতে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের সহায়তায় প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ ভোট কেন্দ্রে ‘সিল মেরে’ বিজয় ছিনিয়ে নেয়।
এবার আবারও তিনি ধানের শীষের হাল ধরে ভোটযুদ্ধে নামছেন, তবে এবার প্রতিপক্ষ শুধু অন্য দল নয়—নিজের আপন ভাইও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কুড়িগ্রাম-৪ আসন ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি ও জামায়াত উভয়ের জন্যই ‘উর্বর ভূমি’। তবে স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে কোনো দলই এ আসনকে স্থায়ীভাবে নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে ধরে রাখতে পারেনি। প্রতিবার ভোটের মাঠে পরিবর্তন এসেছে জোটের সমীকরণ ও প্রার্থী নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে।
স্থানীয় ভোটারদের মতামতেও স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। একপক্ষ বলছেন, “ভাই ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রাজনৈতিক সৌন্দর্য নষ্ট করবে না, বরং গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ রূপ দেখাবে”; অন্যপক্ষের মত, “এমন পরিস্থিতিতে ভোটাররা বিভ্রান্ত হবেন—ভাইয়ের প্রতি আবেগ নাকি দলের প্রতি আনুগত্য, কোনটা প্রাধান্য দেবেন?”
রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনার বিষয়—ভোটের মাঠে এই দুই ভাইয়ের মেধা, যোগ্যতা ও শ্রমের প্রতিযোগিতাই হয়তো নির্ধারণ করবে কে কুড়িগ্রাম-৪ আসনের নতুন সংসদ সদস্য হবেন। বিশ্লেষকদের মতে, জনগণের আস্থা অর্জনে যে প্রার্থী মাঠে সবচেয়ে বেশি সময় ও পরিশ্রম দেবেন, তিনিই শেষ পর্যন্ত বিজয়ের মালা পরতে পারেন।
এখন দেখার বিষয়—ভ্রাতৃত্ব ও রাজনীতির এই মেলবন্ধন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, এবং জনগণ শেষ পর্যন্ত কাকে তাদের প্রতিনিধিত্বের জন্য বেছে নেয়।