মহামারি করোনাভাইরাস আতঙ্কের শুরুতে অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া চালের দাম আবারও বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে কেজিতে চালের দাম বেড়েছে আট টাকা এবং মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১২ টাকা পর্যন্ত। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে চালের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ৭ শতাংশ এবং মাসের ব্যবধানে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
এই দাম বাড়ার তালিকায় চিকন ও মাঝারি চালের পাশাপাশি রয়েছে গরিবের মোটা চালও। অভিযোগ উঠেছে একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী পরিকল্পিতভাবে চালের দাম বাড়িয়েছেন। দাম নিয়ন্ত্রণে চালের বাজারে দ্রুত র্যাব ও ভোক্তা অধিদফতরের অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছেন ভোক্তারা।
ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের দাম বেড়ে যায়। এরপর র্যাব একের পর এক অভিযান পরিচালনা করলে কিছুটা থিতু হয় চালের দাম। প্রায় এক মাস চালের দাম স্থির থাকে। তবে এক সপ্তাহ ধরে আবার দাম বাড়া শুরু হয়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত চিকন চালের দাম আগে বাড়ে। তারপর বাড়ে মোটা চালের দাম। তবে এবার আগে মোটা চালের দাম বেড়েছে। তারপর বেড়ছে চিকন চালের দাম।
তারা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের কারণে কষ্টে থাকা গরিব মানুষের পাশে অনেকে দাঁড়াচ্ছেন। তারা গরিব মানুষকে ত্রাণ হিসেবে মোটা চাল দিচ্ছেন। এ কারণে মোটা চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়ে যায়। এখন নতুন করে চিকন ও মাঝারি চালের দাম বাড়ছে। এর কারণ হতে পারে করোনার শুরুতে যারা চাল কিনেছিলেন তাদের অনেকের চাল শেষ হয়ে গেছে। এখন তারা আবার খাওয়ার চাল কিনছেন। এতে চাহিদা বেড়েছে। এর ফলেই বেড়েছে দাম।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা ব্যবসায়ীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২-৬৮ টাকা কেজি, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৫৫-৬০ টাকা। করোনাভাইরাস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার আগে ছিল ৫২-৫৬ টাকা কেজি। অর্থাৎ চিকন চালের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে আট টাকা এবং মাসের ব্যবধানে ১২ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বাড়ার এই তালিকায় রয়েছে মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চালও। বর্তমানে মাঝারি মানের চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২-৬০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকার মধ্যে। এক মাস আগে ছিল ৪৫-৫০ টাকার মধ্যে।
এদিকে গরিবের মোটা চালের দাম চলতি সপ্তাহে নতুন করে না বাড়লেও গত সপ্তাহেই বেড়ে যায়। বর্তমানে মোটা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৪-৫০ টাকা কেজি, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। করোনাভাইরাস আতঙ্কের আগে ছিল ৩২-৩৫ টাকা।
খুচরা ব্যবসায়ী ও টিসিবির তথ্য মতে, সপ্তাহের ব্যবধানে চিকন ও মাঝারি চালের দাম বেড়েছে এবং মোটা চালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, ১৫ এপ্রিল রাজধানীর খুচরা বাজারে মিনিকেট ও নাজির চালের কেজি বিক্রি হয় ৬০-৬৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৫৫-৬৫ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৫৫-৬০ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে চিকন চালের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং মাসের ব্যবধানে বেড়ছে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ।
অপরদিকে মাঝারি মানের চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকা এবং এক মাস আগে ছিল ৪৫-৫৫ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৮ শতাংশ। মোটা চাল আগের সপ্তাহের মতো ৪২-৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ছিল ৩৪-৪০ টাকা। এ হিসাবে মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।
খিলগাঁও তালতলা থেকে চাল কেনা শরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের পরিবারে চারজন সদস্য। মার্চের শুরুতে ২৫ কেজির এক বস্তা চাল কিনেছিলাম। সেই চাল শেষ হয়েছে। তাই আজ চাল কিনতে এসেছি। আগে যে চালের বস্তা ১৩০০ টাকায় কিনেছি, এখন সেই চাল ১৬০০ টাকা চাচ্ছে। ২৫ কেজি চালের দাম এক মাসে ৩০০ টাকা বেড়েছে। এটা কীভাবে স্বাভাবিক হয়? এদিকে করোনা আতঙ্ক কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, অন্যদিকে পণ্যের দাম ভোগাচ্ছে। কি ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছি বলে বোঝাতে পারবো না।
মালিবাগের বাসিন্দা জয়নাল বলেন, মানবিক বিবেচনায় এখন চাল-ডালের দাম কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আতঙ্কের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দাম। একশ্রেণির ব্যবসায়ী যে পরিকল্পিতভাবে চালের দাম বাড়াচ্ছে, তা সহজেই বোঝা যায়। এই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত র্যাবের অভিযানে নামা উচিত। র্যাব অভিযানে না নামলে দাম আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এর আগে করোনার শুরুতেও চালের দাম বাড়ে। এরপর র্যাব অভিযানে নামলে দাম বাড়া বন্ধ হয়। এখন র্যাবের অভিযান নেই, সেই সুযোগ আবার ওই ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ানো শুরু করেছে।
রামপুরার বাসিন্দা মনিরুল বলেন, কিছুদিন পরই বাজারে নতুন চাল আসবে। এ মুহূর্তে চালের দাম বাড়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কারসাজি চক্র পরিকল্পিতভাবে চালের দাম বাড়াচ্ছে। এই চক্রই দেখবেন কিছুদিন পরে কম দামে কৃষকের ধান কিনবে। কৃষক ধানের দাম পাবে না। অথচ এই চক্র ঠিকই চালের দাম বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নেবে।
খিলগাঁওয়ের ব্যবসায়ী মো. জানে আলম ভূঁইয়া বলেন, ত্রাণ দিতে অনেকে মোটা চাল কিনছেন। এ কারণে বাজারে মোটা চালের চাহিদা বেড়েছে। ফলে গত সপ্তাহেই বেড়েছে দাম। তবে গত সপ্তাহে চিকন চালের দাম কিছুটা কমছিল। কিন্তু এখন আবার বেড়েছে। পাইকারিতে সপ্তাহের ব্যবধানে চিকন চালের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ কারণে আমরা বাড়তি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের ধারণা নতুন চাল আসলে দাম কিছুটা কমতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এর আগে যতবার চালের দাম বেড়েছে আগে চিকন চালের দাম বেড়েছে। এরপর মোটা চালের দাম। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। আগে মোটা চালের দাম বেড়েছে, তারপর চিকন চালের। আমাদের ধারণা পাইকারি বাজারে অভিযান চালালে চালের দাম কমে যেতে পারে। এর আগে র্যাব অভিযান চালানোর কারণে কয়েক সপ্তাহ চিকন চালের দাম স্থির ছিল। কিন্তু এখন র্যাবের অভিযান না থাকায় আবার নতুন করে দাম বাড়ছে।
রামপুরার ব্যবসায়ী মিলন বলেন, আমাদের ধারণা ছিল চালের দাম নতুন করে আর বাড়বে না। কারণ কিছুদিন পরই বাজারে নতুন চাল আসবে। কিন্তু আমাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে চিকন চালের দাম বেড়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকরা জানিয়েছেন এখন ধানের অভাব রয়েছে। ধানের দামও বেশি। আবার ঢাকায় চাল আনতে ঠিকমত পরিবহন পাওয়া যাচ্ছে না। যে পরিবহন পাওয়া যাচ্ছে তার জন্য বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। এ কারণে চালের দাম বেড়েছে। নতুন চাল আসলে এবং পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক হলে দাম কিছুটা কমে যাবে।
ভিন্নবার্তা/এমএসআই