হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন। মারা যাননি। এ নিয়ে রয়েছে নানা কৌতূহল। রয়েছে বিতর্ক। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন সত্যি হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন। অনেকের মতে হারিছ গোয়েন্দাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতেই মৃত্যুর খবর প্রচার করেছেন। বাস্তবে কি? কোনটা সত্য। অনুসন্ধান কি বলছে।
গত ১৫ই জানুয়ারি ‘দৈনিক মানজমিন’ খবর দেয় হারিছ চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মারা গেছেন। হারিছের বিলেত প্রবাসী মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা চৌধুরী এটা নিশ্চিত করেন। বলেন, তার বাবা হারিছ চৌধুরী গত বছরের ৩রা সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা গেছেন। যদিও তার চাচা আশিক চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, হারিছ ঢাকায় নয়, লন্ডনে মারা গেছেন। এই খবর প্রকাশের পর অনেকেই বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দেন। গোয়েন্দারাও একাধিকবার ফোন করে সত্যটা জানতে চান। এরপর থেকে অনুসন্ধান চালতে থাকে। অনুসন্ধানে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী আসলে মারা যাননি। মারা গেছেন মাহমুদুর রহমান। হারিছ চৌধুরী দীর্ঘ ১৪ বছর গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি ভারত কিংবা লন্ডনেও যাননি। বাংলাদেশের ভেতরেই ছিলেন এবং ঢাকাতেই বেশিরভাগ সময় কাটান। ওয়ান ইলেভেনের পরপরই কিছুদিন সিলেটে অবস্থান করেন। ঢাকায় আসার পর তিনি নাম বদল করেন। নাম রাখেন মাহমুদুর রহমান। দীর্ঘ ১৪ বছর এই নামেই পরিচিত ছিলেন। পরিচয় দিতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে। ঢাকার পান্থপথে প্রায় ১১ বছর কাটিয়ে দেন এই পরিচয়ে। এই সময় তিনি মাহমুদুর রহমান নামে একটি পাসপোর্টও নেন। পাসপোর্ট নম্বর BW0952982। এতে ঠিকানা দেন শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার। বাবার নাম আবদুল হাফিজ। ২০১৮ সনের ৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে এই পাসপোর্ট ইস্যু হয়। পাসপোর্টে দেয়া ছবিতে দেখা যায় এ সময় তার চেহারায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। সাদা লম্বা দাড়ি। চুলের রঙ একদম সাদা। বয়সের ছাপ পরেছে। শুধু পাসপোর্ট নয় জাতীয় পরিচয় পত্রও পেয়ে যান মাহমুদুর রহমান নামে। তার এনআইডি নম্বর হচ্ছে ১৯৫৮৩৩৯৫০৭। পাসপোর্ট ও এনআইডি‘র সূত্র ধরে ‘মানবজমিন’ অনুসন্ধান চালাতে থাকে। প্রায় দু’মাস অনুসন্ধানের পর ‘মানবজমিন’ জানতে পারে অধ্যাপক মাহমুদুর রহমানই আলোচিত রাজনৈতিক নেতা হারিছ চৌধুরী। ঢাকায় কিভাবে ছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ আমরা পেয়েছি। ঢাকার পান্থপথে একটি ভাড়া করা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকতেন। বাসা থেকে খুব একটা বের হতেন না। একজন কাজের বুয়া ও একটি ছেলে থাকতো তার সঙ্গে। বই পড়ে সময় কাটাতেন। নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত। নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেছেন, আমি তিন বছর ধরে এখানে কাজ করি। তার সম্পর্কে ব্যক্তিগত তথ্য খুব একটা জানতাম না। শুনেছি তার স্ত্রী ও সন্তানরা থাকেন লন্ডনে। কেউ কোন দিন আসেনি। আসা যাওয়ার সময় সালাম দিতাম। তিনি হাসি মুখে সালাম নিতেন। তাকে সবাই প্রফেসর সাহেব বলেই জানতো। নিঃসঙ্গ এই মানুষটির মৃত্যুও হয় নিঃসঙ্গতায়।
সাইফুল জানান, একদিন ভোর রাতে কেউ একজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শুনেছি হাসপাতালে থাকার পর তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর তার মেয়েকে দেখি। প্রথমে আমাদেরকে জানাতেও চাননি স্যার মারা গেছেন। মারা যাবার পর দুই মাস এই বাড়িতেই ছিলেন জামাইসহ। গত জানুয়ারিতে তারা বাসা ছেড়ে দেন। হারিছ চৌধুরী খুব একটা বের হতেন না। কথাও বলতেন না। এই বাসার সামনের একটি ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনতেন। সেই ফার্মেসী সূত্রে জানা যায়, তিনি উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিক ও হৃদরোগের ওষুধ কিনতেন।
ফার্মেসীর মালিক সুমন খন্দকার বলেন, স্যার খুব ভাল মানুষ ছিলেন। কখনো বাকিতে ওষুধ নিতেন না। পাশেই একটি মুদি দোকান। এই দোকান থেকেই জিনিষপত্র কিনতেন। দোকানের মালিক মোহাম্মদ সুজন বলেন, তিনি তো খুব ভাল মানুষ ছিলেন। সব সময় আমার দোকান থেকে চাল, ডাল, তেল এসব প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেন। ফ্ল্যাট মালিক জানান, তার মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানেন না। প্রফেসর সাহেব নিয়মিত ভাড়া দিতেন। ভাল মানুষ ছিলেন।
কিভাবে মারা গেলেন এবং কোথায় দাফন হলো
মাহমুদুর রহমান নামেই হাসপাতালে ভর্তি হন। দাফনও হয় এই নামে। ‘মানবজমিন’ এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত বছর ২৬শে আগস্ট করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। এর আগে অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মারা যান ৩রা সেপ্টেম্বর। ডেথ সার্টিফিকেটে বলা হয়েছে তিনি Covid with Septic Shock এ মারা গেছেন। তিনি প্রফেসর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মাহবুব নূরের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৪ঠা সেপ্টেম্বর সার্টিফিকেট ইস্যু করেন সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আ, ক, ম, নূর।
তার মৃতদেহ গ্রহণ করেন মেয়ে সামিরা চৌধুরী। এরপর একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে গোসলের জন্য মোহাম্মদপুর নিয়ে যান। কাফনের কাপড় কেনেন মোহাম্মদপুরের মাইকআউস স্টোর থেকে। আমাদের কথা হয় সামিরা চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, প্রথমে কেউই করোনা আক্রান্ত রোগীর লাশ গোসল করাতে রাজি হয়নি। পরে যাই হোক রাজি হওয়ার পর গোসল সম্পন্ন হয়। তিনি জানান দাফন নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। কোথায় দাফন হবে। এরপর আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে সাভারে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়। লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সাভারের লালাবাদ কমলাপুরে। জামিয়ার কর্ণধার শাইখুল হাদিস আশিকুর রহমান কাশেমী সাহেব সম্মত হন। এরপর তাকে জামিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণেই দাফন করা হয়। কেন এই গোপনীয়তা এবং লুকোচুরি জানতে চাইলে সামিরা চৌধুরী বলেন, ১৪ বছর যে মানুষটি আত্মগোপনে ছিলেন তার খবর প্রকাশ করা সহজ ছিল না। নানা ভয় আর আতঙ্ক কাজ করেছে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি অধ্যাপক মাহমুদুর রহমানই আমার বাবা হারিছ চৌধুরী। ডিএনএ টেস্ট করলেই এটা খোলাসা হয়ে যাবে। জীবিত থাকা অবস্থায় আমি লন্ডন থেকে টেলিফোনে উনার সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। আমার স্বামীও চার বছর আগে একবার ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করে।
সুইজারল্যান্ডে অবস্থানরত আমার ভাই নায়েম শাফি চৌধুরীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সে এখন সুইজারল্যান্ডে সিনিয়র এনার্জি এনালিস্ট হিসেবে কর্মরত রয়েছে। সেলিম চাচাও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। যিনি সম্প্রতি মারা গেছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, হারিছ চৌধুরী দু’বার আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার পরামর্শকরা এতে সায় দেননি।
উল্লেখ করা যায় যে, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় হারিছ চৌধুরীর যাবজ্জীবন সাজা হয়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ, এম, এস, কিবরিয়া হত্যা ও বিস্ফোরক মামলারও আসামি ছিলেন হারিছ চৌধুরী। বিগত ১৪ বছর গোয়েন্দারা তাকে হন্য হয়ে খুঁজেছেন। কিন্তু তার সন্ধান পাননি। হারিছ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম, এ ডিগ্রি নেন।
(প্রতিবেদনটি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর লেখা )
Editor: Rumana Jaman Shachi
Raipura House (2nd Floor), 5/A, Outer Circular Road
West Malibag, Dhaka-1217
Communication
E-mail: vinnabarta@gmail.com
Phone:+8802222220051