নৌপথে ‘কোস্ট গার্ড, নৌ-পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কর্তৃক চাঁদাবাজি বন্ধ সহ ছয় দফা দাবি জানিয়েছেন পণ্যবাহী নৌযান মালিকরা।
আজ বেলা ১২টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান তারা। মাহবুব উদ্দিন আহম্মেদ (বীর বিক্রম) এবং ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির নেতৃত্বাধীন নৌযান ব্যবসা সমৃদ্ধি ঐক্য পরিষদ এর ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেলওনার্স এসোসিয়েশনের (বিসিভোয়া) সাবেক সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ডব্লিউটিএ এর বাইরে সিরিয়াল বিহীন জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে হবে। জাহাজে ডাবল মাষ্টার ও ডাবল ড্রাইভার প্রথা বাতিল করতে হবে। ৫০ মিটার ঊর্ধ্ব জাহাজের ক্ষেত্রে নির্মাণকালীন সময় থেকে জাহাজ সচল থাকা অবস্থা পর্যন্ত বেক্রসিং প্রদান করতে হবে এবং সিলেট, সুনামগঞ্জ, নগরবাড়ী ও খুলনা নোয়াপাড়া রুটে নদী ড্রেজিং করতে হবে। এসময় উপস্থিত ছিলেন, কোষ্টাল শিপ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) এন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির, নৌ-যান ব্যবসা সমৃদ্ধি ঐক্য পরিষদ এর অন্যতম নেতা রাকিবুল আলম দিপু, খুরশিদ আলম ও লক্ষণ চন্দ্র ধর প্রমুখ।
আমরা সব সময়ই সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম উল্লেখ করে মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি অশুভ চক্র পণ্যবাহী নৌ-যান ব্যবসা কুক্ষিগত করার জন্য সুক্ষভাবে কাজ করছে। এই অবস্থার অন্তর্নিহিত কারণ সমূহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমূহ যদি একটি সম্মানজনক সমাধান না করেন তবে আমাদের নৌ-যান পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত দাবিগুলো বাস্তবায়নে আগামী ৩ (তিন) মাসের সময়সীমা বেঁধে দেন নৌযান মালিকরা। অন্যথায় কর্মবিরতিসহ কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারিও দেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, বিশ্বব্যাপী করোনা আতঙ্কের মধ্যেও মানুষের রুটি রুজি অন্বেষণের প্রয়োজনে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সকল জাহাজ মালিকদের বাধ্য হয়ে আজ একত্রিত হতে হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন, কোস্টাল শিপ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ওয়েল ট্যাংকার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার্স ওনার্স এসোসিয়েশন এবং লঞ্চ ওনার্স এসোসিয়েশন এর উদ্যোগে নৌযান শ্রমিকদের অযৌক্তিক খাদ্য ভাতা প্রদানের জন্য গত বছরের ১৯ অক্টোবর হতে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বেআইনি ধর্মঘট আহ্ববানের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ অক্টোবর (২০২০) বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গত বছরের ১৯ অক্টোবর হতে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত শ্রমিক কর্মচারী অযৌক্তিক খাদ্যভাতা প্রদানের বিষয়ে অনড় থাকায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ দেশের এই সংকটকালে কোন শ্রেনী ও পেশাজীবীদের মধ্যে কোন প্রকার অসন্তোষ যাতে সৃষ্টি না হয় সেই প্রেক্ষিতে আমাদের যৌক্তিক দাবি সমাধানের আশ্বাস দিয়ে নৌ-যান মালিকদের একটি সম্মানজনক খাদ্য ভাতা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান।
এরই প্রেক্ষাপটে সরকারের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন জাহাজ মালিকগণ ব্যবসায়িকভাবে নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যে অবস্থান করছেন। তার উপর বর্ধিত হারে খাদ্য ভাতা প্রদান করলে জাহাজ মালিকগণের জাহাজ চলাচল সংকটে পড়বে। পণ্যবাহী নৌ-যান চলাচলে যে যে বিষয়ে প্রতিকূলতা রয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করলে সরকারের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ নেতৃবৃন্দদের আশ্বস্ত করেন আমরা অচিরেই আপনাদের বিদ্যমান সমস্যা সমূহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাপ আলোচনা করে নৌ-যান ব্যবসার বিদ্যমান সমস্যা সমূহ নিরসন করে দিবেন। যা অদ্যাবধি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি, উপরন্তু প্রতিটি জাহাজে বেতন ভাতার সাথে আরো ৫০ (পঁঞ্চাশ) হাজার টাকা যুক্ত হয়ে পণ্যবাহী নৌ-যান মালিকগণ বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন।
আজকের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা মজবুত রাখার জন্য নৌ-পথে পণ্য পরিবহন সহজলভ্য হওয়ায় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ এবং চলমান উন্নয়ন বেগবান হচ্ছে। এই ব্যবস্থাপনাকে বিপদে ফেলতে এবং সুষ্ঠু পরিস্থিতিতে অস্থিতিশীল করতে একটি দুষ্টু চক্র এখানে সংঙ্গবদ্ধ হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা ও মানুষের জীবন যাত্রার মানকে অস্থিতিশীল করাই এর উদ্দেশ্য।
সংবাদ সম্মেলনে যেসব সমস্যার কথা তুলে ধরা হয় তা হচ্ছে:
চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরে বিহিঃনোঙ্গরে থাকা পণ্যবাহী জাহাজ (মাদার ভেসেল) থেকে মালামাল খালাস করার জন্য কার্গো জাহাজ ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও হাতে গোনা কয়েকজন এজেন্ট নিয়ম বহির্ভূতভাবে বাল্কহেড ব্যবহার করে পণ্য খালাশ করছে। যার সঙ্গে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। এর ফলে সাধারণ কার্গো জাহাজ মালিকরা প্রতিনিয়ত আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। উল্লেখ্য সার্ভে, রেজিষ্ট্রেশন এবং বে-ক্রসিংয়ের অনুমোদ ছাড়া কোন জাহাজ বহিঃনোঙ্গরে যেতে পারবে না এবং WTC-র কোন প্রকার পণ্যও পরিবহণ করতে পারবে না। মূলত, বহিঃনোঙ্গর থেকে মালামাল পরিবহন করা এসব বাল্কহেডের উল্লেখিত কোন অনুমোদনই নেই।
WTC-এর নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু পণ্যের এজেন্টরা সিরিয়াল বহির্ভূতভাবে পণ্য পরিবহন করছে। এর ফলে সাধারণ জাহাজ মালিকরা মাসের পর মাস সিরিয়াল না পেয়ে বহিঃনোঙ্গরে বসে থাকে। অন্যদিকে পণ্যের এজেন্টদের সু-দৃষ্টিতে থাকা গুটি কয়েক জাহাজ প্রতি মাসেই একাধিক ট্রিপ পাচ্ছে। এতে করে সাধারণ জাহাজ মালিকরা মাসের পর মাস ট্রিপ না পেয়ে জাহাজের কর্মচারীদের বেতন ও তেল খরচের টাকাও জোগাড় করতে পারছে না।
জাহাজে ডাবল মাষ্টার ও ডাবল ড্রাইভার প্রথা বাতিল করতে হবে। কারণ, বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিটি জাহাজের বেতন ও খাদ্য ভাতা মিলে ৩,০০,০০০ (তিন লাখ) টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। আরও একজন মাষ্টার ও ড্রাইভার নিয়োগ করলে বেতন ভাতা প্রতি মাসে আরও ৫০,০০০ (পঁঞ্চাশ হাজার) টাকা বৃদ্ধি পাবে, ফলে জাহাজ পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এখানে উল্লেখ্য যে প্রতিটি জাহাজে ২ জন কোয়াটার মাষ্টার (সুকানি) এবং দুইজন ইঞ্জিন চালক সাহায্যকারী বিদ্যমান রয়েছে। বাস্তবতায় দৈনিক মাত্র ৮ ঘণ্টা জাহাজ পরিচালনায় দুইজন মাষ্টার ও দুইজন ড্রাইভার প্রয়োজন হয় না। এই আদেশ প্রদানের ফলে প্রতিটি ঘাটে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের ইন্সপেক্টরগণ, BIWTA এর ইন্সপেক্টরসহ নৌ-পুলিশ, কোস্ট গার্ডের সদস্য বৃন্দদের প্রতি ট্রিপে চাঁদা দিতে হচ্ছে। বর্তমানে আমরা (নৌযান মালিক) এক মাসের অধিক সময়ে একটি ট্রিপ পরিবহন করার সুযোগ পাচ্ছি, ফলে দেড় মাসে সর্বমোট ৭ (সাত) দিন পণ্য পরিবহন জাহাজ চলাচল করে।
৫০ মিটার ঊর্ধ্ব জাহাজের ক্ষেত্রে নির্মাণকালীন সময় হতে ১৫ বছর পর বে-ক্রসিং প্রদান করা হচ্ছে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি জাহাজ নির্মাণ কাল হতে ৩০ বৎসর পর্যন্ত চলাচলের সার্ভে প্রদান করা হচ্ছে। ৩০ বৎসর পরবর্তী জাহাজের কন্ডিশন অনুযায়ী আরও ৫ বৎসর সার্ভে বর্ধিত করা হচ্ছে। প্রতিটি জাহাজ প্রতি বছর সার্ভের পূর্বে সঠিকভাবে ডকিং করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত পূর্বক সার্ভে টোকেন প্রদান করা হয়। ১৫ বৎসর বয়স সম্পন্ন জাহাজ সমূহ চলাচলের উপযোগী হলে বে-ক্রসিং প্রদান না করা যুক্তিসংগত নয় বলে আমরা মনে করি। সংশয় প্রকাশ করলে ১৫ বৎসর বয়সের অধিক জাহাজের বডির প্লেট সঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে গেজিং সার্টিফিকেট প্রদানের প্রস্তাবনা করে বে-ক্রসিং এর সার্টিফিকেট দিতে হবে।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, নগরবাড়ী ও খুলনা নোয়াপাড়া রুটে নদী সমূহে নাব্যতা কম থাকায় সারা বছর পণ্য পরিবহন ক্ষমতা অনুযায়ী পণ্য পরিবহনে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে জাহাজ গুলি। তাই এই সকল স্থানে দ্রুত ড্রেজিং করে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আজকের সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নৌ-পথের বিভিন্ন জায়গায় নৌ-পুলিশ, কোস্ট গার্ড, BIWTA ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কর্তৃক চাঁদাবাজি হয়, যা আমাদের জাহাজ মালিকদের বহন করতে হয়। দ্রুত এসব চাঁদাবাজী বন্ধের দাবি জানান নৌযান মালিকগণ।
ভিন্নবার্তা ডটকম/এন