জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) কোনো শয্যাই ফাঁকা নেই। শয্যা ছাপিয়ে ওয়ার্ডের ভেতর, বারান্দা, করিডোর থেকে শুরু করে সিঁড়ি পর্যন্ত দীর্ঘলাইন দিয়ে রোগী শুয়ে আছে। মেঝেতে অতিরিক্ত শয্যা দেয়ার পরও রোগীর ভিড় সামলাতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগীরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শয্যা বিছিয়ে শুয়ে আছেন, এরপরও রোগীর চাপ কমছে না।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী দিনের পর দিন শয্যাবাণিজ্য করে আসছেন। দিনে তিন-চারবার শয্যা বিক্রি করা হয় ২০০ থেকে এক হাজার টাকায়। টাকা না দিলে দিনের পর দিন হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে থাকতে হয়। যারা টাকা দিতে পারছে না তাদের হাসপাতালের মেঝেই একমাত্র ভরসা। এমন চক্র রয়েছে হাসপাতালটির প্রতিটি ওয়ার্ডে। সরেজমিনে ঘুরে ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নরসিংদীর রায়পুরা থানার বালুয়াকান্দি কান্দাপাড়া গ্রাম থেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা মো. জাকারিয়া (৫৩) বলেন, বুকে ব্যথা অনুভব করায় হৃদরোগ হাসপাতালের তৃতীয় তলার কার্ডিওলজি পুরুষ বিভাগের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হই। ভর্তি হলেও সিট পাইনি। এ জন্য ওয়ার্ডের মেঝেতেই থাকতে হলো। হাসপাতালে এসে পাশের এক রোগীর স্বজন জানান, টাকা দিলেই মিলবে সিট। এরপর একদিন অতিবাহিত হলে ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সে জানায়, ৩০০ টাকা হলেই মিলবে সিট। যেই কথা সেই কাজ। ৩০০ টাকা দেয়ার পর বি-১৯ সিট মিলে গেল।
কুমিল্লা থেকে আসা আরেক ভুক্তভোগী হাবিবুর রহমান (৫৮) বলেন, ‘আমি আগে থেকেই অসুস্থ। বুকে ব্যথা হলে ঢাকায় এসে হৃদরোগ হাসপাতালে কার্ডিওলজি ওয়ার্ডে ভর্তি হই। এত রোগী ফ্লোরে শুয়ে আছে যে আমিও সিট না পেয়ে তাদের মতো ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম। পরে জানতে পারলাম টাকা হলেই নাকি সিট পাওয়া যায়। এর দুদিন পর একজনকে ৫০০ টাকা দিলাম। এরপর বি-২০ সিট পেলাম।’ টাকা কাকে দিয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নাম তো বলতে পারি না। রোস্টার অনুযায়ী ডিউটি করে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিশোরগঞ্জ থেকে আসা এক রোগী বলেন, ‘টাকা দিতে না পারায় দীর্ঘদিন ফ্লোরে পড়ে আছি। অথচ আমার পরে কত রোগী ভর্তি হলো। তারা টাকার বিনিময়ে বেড পেল। আমি টাকা দিতে পারিনি বলেই চিকিৎসা নিচ্ছি সেই ফ্লোরের বেডে। এখানে টাকা দিলেই সব হয়। সরকার দুর্নীতি কমানোর জন্য কত পদক্ষেপ নিচ্ছে আর এরা চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের সাথে এ রকম ছয়-নয় করছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থেকে আসা লিপি বেগম (৩৮) বলেন, মঙ্গলবার আমার বাচ্চা হয়েছে। এরপর থেকেই বুকে ব্যথা। তারপর ওই দিনই কার্ডিওলজি (মহিলা ও শিশু-৩) ওয়ার্ডে ভর্তি হই। ভর্তি হলেও বেড না থাকায় বারান্দায় ফ্লোরে ছিলাম। মাত্র পাঁচ দিনের বাচ্চা রেখে এসেছি। বুধবার ৫০০ টাকা দিয়ে এক্স-৩৩ বেড পাই।’ কাকে টাকা দিয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখি এখানে ডিউটি করে নাম জানি না। টাকা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই বেড পেলাম।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, আমাদের এখানে সব ওয়ার্ড মিলিয়ে ৪০০ বেড আছে। এর মধ্যে করোনার জন্য নিচের ওয়ার্ড ছেড়ে দিতে হয়েছে। হাসপাতালে বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি তারপরও আমরা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। করোনার আগে প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ রোগী ভর্তি হতো আর এখন ৭০-৮০ জন রোগী ভর্তি হয়। বেড সংকটে আমাদের ওপর ভবনের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে ১ হাজার ২০০ রোগী রাখা যাবে।
শয্যাবাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, আগে একবার এ রকম অভিযোগ শুনেছিলাম। তখন ওয়ার্ড মাস্টারদের ডেকে তাদের ডিউটি অন্য জায়গায় দিয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন- এ জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।
ভিন্নবার্তা/এসআর