উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা পঞ্চগড়ে এখন ভোর হলেই দেখা মিলছে ঘন কুয়াশার। মৌসুমি বায়ু নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় উত্তরের দিক থেকে বইছে হিমেল হাওয়া, যা প্রকৃতিতে শীতের আগমন জানান দিচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরেই জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলাসহ আশপাশের এলাকায় সকালে ঘন কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে সকাল ৭টা পর্যন্ত চারপাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে। তবে দুপুরের পর রোদের তেজে গরম অনুভূত হলেও, সকাল ও রাতে বেশ ঠান্ডা লাগছে।
সাধারণত অক্টোবরের শুরু থেকে পঞ্চগড়ে শীতের আমেজ শুরু হয়, আর ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে তীব্র শীত পড়ে। এবার শরতেই মেঘলা আকাশ আর মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টিতে শীতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে আগেভাগেই। বর্তমানে জেলায় দিনের তাপমাত্রা ২৮–২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতের তাপমাত্রা ২৪–২৫ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। স্থানীয়রা রাতের দিকে হালকা কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া ভোরের দিকে মাঠে-মাঠে ফসল, ঘাস ও গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরও স্পষ্ট করছে শীতের পদধ্বনি।
প্রতি বছর শীত শুরু হলে পঞ্চগড়ের নদী, খাল-বিল, গ্রামীণ সড়ক, ফসলের মাঠ—সবকিছুতেই কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ে এক বিশেষ সৌন্দর্য নিয়ে। গরমের পর এই ঠান্ডা হাওয়া মানুষের মনে শান্তি আনে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগাম শীতের ছোঁয়ায় ইতোমধ্যেই জমি চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা—শুরু হয়েছে শীতকালীন সবজি, গম, আলু চাষ। সূর্য উঠার পরেও কুয়াশা আর মৃদু ঠান্ডা বাতাস প্রকৃতির রূপকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলছে।
সন্ধ্যার পর তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যাওয়ায় অনেকেই এখন গরম কাপড় পরছেন। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকরা ভোরে ও রাতে হালকা জ্যাকেট পরে চলাফেরা করছেন। একইসঙ্গে জেলা শহরের লেপ-তোশক ব্যবসায়ীদেরও প্রস্তুতি নিতে দেখা যাচ্ছে।
তবে এই হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। সর্দি-কাশি, জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে ঘরে ঘরে। শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি ভোগছেন এসব সমস্যায়। পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিনই এসব রোগে আক্রান্ত অনেক রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মনোয়ার হোসেন জানান, মৌসুমি পরিবর্তনের এ সময় সাধারণত জ্বর, সর্দি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ার মতো রোগ দেখা দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি বলেন, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের ঠান্ডা ও বাসি খাবার এড়িয়ে চলা, সন্ধ্যার পর অপ্রয়োজনে বাইরে না যাওয়া এবং মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
জেলা শহরের লেপ-তোশক ব্যবসায়ী মনছুর আলম বলেন, এখনই তাদের জন্য লেপ-তোষক ও শীতের কাপড় মজুদের উপযুক্ত সময়। কারণ শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব সামগ্রীর দাম ও চাহিদা দুটোই বাড়ে। তখন বাইরে থেকে তুলা বা কাপড় আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
হাফিজাবাদ ইউনিয়নের মারুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আল আমিন জানান, যদিও এখন শীত শুরু হওয়ার সময় হয়নি, কিন্তু টানা কয়েকদিনের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে শীত যেন আগেই এসে গেছে। ভোরে ঘুম থেকে উঠলে চারদিক কুয়াশায় ঢাকা দেখা যায়, আর হালকা বাতাসে ঠান্ডা অনুভব হয়। এখন রাতের বেলা কাঁথা ছাড়া ঘুমানো যায় না।
ডোকরোপাড়া মহল্লার রাইজুল ইসলাম জানান, করতোয়া নদীর পাড়ে বসবাস করায় প্রতিদিন ভোরেই তিনি কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ দেখতে পান। বৃষ্টি হলে ঠান্ডা আরও বাড়ে, তবে দিনের বেলা রোদের কারণে আবার গরম লাগে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পঞ্চগড় জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষক আজহারুল ইসলাম জুয়েল বলেন, প্রতিবছর শীত এলেই এখানকার দরিদ্র মানুষের জন্য কিছুটা দুর্ভোগ হলেও জেলার মানুষ মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। এবার বর্ষার পরে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় স্বাভাবিক সময়ের আগেই শীতের আমেজ দেখা দিচ্ছে।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ রায় জানান, বর্তমানে মৌসুমি বায়ুর নিষ্ক্রিয়তার কারণে উত্তর দিক থেকে হিমেল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে, যা ভোরের দিকে কুয়াশা সৃষ্টি করছে। আকাশে মেঘ থাকায় বৃষ্টির সম্ভাবনাও থাকছে। মেঘ কেটে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তবে এই ভোরের কুয়াশাময়তা স্পষ্টতই শীত আসার পূর্বাভাস দিচ্ছে।