পরিবেশদূষণ বাংলাদেশকে আঁকড়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। চারদিকে দূষণ, দূষণ আর দূষণ। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ। কোনো প্রতিকার নেই, দূষণ বেড়েই চলেছে। দেশের মানুষ বেঁচে আছে অসহায় অবস্থায়। দেশে বায়ুদূষণ এখন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বায়ুদূষণে আক্রান্ত সারা দেশ। প্রতিটি জেলাতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে বায়ুর মান তুলনামূলকভাবে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। রাজধানী ঢাকার বায়ুর মান সবচেয়ে বেশি অস্বাস্থ্যকর। বিশ্বের খারাপ বায়ুর মানের তালিকায় মাঝে-মাঝেই ঢাকা শীর্ষস্থানে চলে যায়। অন্য সময় দুই বা তিন নম্বরে থাকে। সময়ে সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানান উদ্যোগের কথা শোনা যায়। কিন্ত সেই সব উদ্যোগের ঘোষণা যেন বক্তৃতা বা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ বলেন, উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল নীতিমালায় পরিবেশের বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে এবং পরিবেশ নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই আমাদের পরিকল্পনা ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য সরকার, পরিবেশ অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা আবশ্যক। নগরবাসীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই দূষণের উৎসসমূহ বন্ধ করতে হবে। বায়ু দূষণের সকল উৎস বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
সূত্র মতে, সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’ বিশ্বের প্রধান প্রধান শহরের বায়ুর মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এ সংস্থা গত ২৮ ফেব্রুয়ারি যে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) রেকর্ড করেছে, তাতে ঢাকার স্কোর ছিল ২৪২। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ এ স্কোর। ঢাকার পরেই ছিল যৌথভাবে কাজাখস্তানের নূর-সুলতান নগরী ও পাকিস্তানের লাহোর। এ দুই শহরের একিউআই স্কোর ওইদিন ছিল ১৮৭। একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। এর উপরে গেলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা মানুষের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।
বিশেষজ্ঞদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী এ দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন প্রায় ৭৩ বছর। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা মনে করেন, বায়ুদূষণ না থাকলে এবং বায়ুর মান স্বাস্থ্যকর থাকলে মানুষের গড় আয়ু অবশ্যই আরও বেশি থাকত। লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রকৃতপক্ষে কমছে। ১৯৯৮ সালে বায়ুদূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় দুই বছর আট মাস। ২০১৯ সালে একই কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে পাঁচ বছর চার মাস। আর রাজধানী ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুসের রোগ, বক্ষব্যাধিসহ বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। মৃত্যুও বাড়ছে। অতএব গড় আয়ু কমবেই।
বিভিন্ন গবেষণায় বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হিসাবে যেসব উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ইটভাটা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিভিন্ন নির্মাণকাজের ধুলা, সমন্বয়হীন সংস্কারকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, শহরের বর্জ্য উন্মুক্ত জায়গায় পোড়ানো, নিম্নমানের কয়লা ও তরল জ্বালানি ব্যবহার ইত্যাদি।
পরিবেশদূষণের ক্ষেত্রে বায়ুর পরেই রয়েছে পানিদূষণ। দেশের কোথায় দূষণমুক্ত পানি পাওয়া যাবে, সেটা একটা গবেষণার বিষয়। দেশে নদীর প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য কোথাও নেই। নদীর সংখ্যা যাই হোক, প্রশ্ন হচ্ছে দূষণমুক্ত কোনো নদী দেশে আছে কি? প্রতিটি নদীই তো দখল-দূষণের শিকার। কোনো নদীই মানুষকে দূষণমুক্ত পানি দিতে পারছে না। এজন্য কি নদী দায়ী, না মানুষ? মানুষের কর্মকাণ্ডেই নদীর পানি দূষিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে মানুষই বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নদীর দূষণ দেখতে রাজধানী ঢাকা থেকে দূরে যেতে হবে না। মহানগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার কী অবস্থা হয়েছে দখলে-দূষণে, তা জনগণ, সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবাই জানে। সদরঘাট দিয়ে যারা লঞ্চে বা বিভিন্ন নৌযানে যাতায়াত করেন, তারা আরও ভালো জানেন। নদীর পানি কালো হয়ে গেছে। দুর্গন্ধে টেকা দায়। এই নদীতে এককালে মাছ পাওয়া যেত। সেটা এখন ইতিহাস। মাছ কেন, পোকামাকড়ও এই দূষিত বিষাক্ত পানিতে বাঁচতে পারে না। বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীর দখলমুক্ত করতে মাঝে-মাঝেই অভিযান চালানো হয়। অভিযান শেষ হলেই আবার দখল হয়ে যায়। এভাবেই চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। বুড়িগঙ্গার তলদেশে এখন বালু বা মাটি নেই। আছে পলিথিন, প্লাস্টিক ও শক্ত বর্জ্যরে আবরণ। এ আবরণ কত মিটার পুরু, সেটিও গবেষণার বিষয়।
ঢাকা ওয়াসা বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি পরিশোধন করে ঢাকাবাসীকে সরবরাহ করে। ওয়াসার দাবি পরিশোধিত এই পানি বিশুদ্ধ এবং পান করার যোগ্য। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কি তাই? সম্প্রতি রাজধানীতে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড় পরিমাণ বাড়তে থাকলে আলোচনায় আসে ওয়াসার পানি। চিকিৎসকসহ বিশেষজ্ঞরা সবাই একযোগে বলছেন, ওয়াসার পানিতে মারাত্মক জীবাণুর পাশাপাশি দুর্গন্ধ থাকার কারণে ডায়রিয়ার সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এদিকে ওয়াসাকে পানির জন্য দাম দিতে হয় এবং এই দাম নিয়মিত বাড়ানো হচ্ছে। এবার আবারো দাম বাড়নো হয়েছে। চুলা ব্যবহারের জন্য গ্যাস কিনতে হয়। সেটার দামও দফায় দফায় বাড়ছে। ওয়াসার পানি ময়লামুক্ত করতে ফিল্টার মেশিন কিনতে হয় কয়েক হাজার টাকা দিয়ে। এই মেশিনের ফিল্টার পরিবর্তন করতে হয় নিয়মিত, না হলে মেশিন কাজ করবে না। বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি পান করতে নগরবাসীকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। মানুষ যাবে কোথায়?
এরপর আছে শব্দদূষণ। অনেকে শব্দদূষণকে শব্দসন্ত্রাস নামে আখ্যায়িত করেন। কৃত্রিম বা যান্ত্রিকভাবে সৃষ্ট শব্দ যখন মাত্রা অতিক্রম করে তখন পরিবেশ দূষিত হয়, মানুষের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন আবার রাস্তায় হাজার হাজার মোটরবাইক দেখা যায়। এগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে সস্তা ও সহজলভ্য। তরুণ-যুবকরাই এগুলোর চালক। তরুণ-যুবকরা তীব্র শব্দ সৃষ্টি করে দ্রুতগতিতে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায় এরা দল বেঁধে উদ্দাম গতিতে বাইক চালাচ্ছে শহরের রাস্তায়। এরা কারা সহজেই অনুমেয়। ট্রাফিক পুলিশ মাঝেমাঝে ব্যবস্থা নিলেও রাজনৈতিক কারণে সেগুলোও তেমন কাজে আসেনা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, দ্রুত নগরায়ণের ফলে রাজধানীতে যানজট এবং শব্দদূষণ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এমনকি এ শব্দদূষণের মাত্রা এমন যে, এর প্রভাবে আমাদের শ্রুতি ও দৃষ্টি শক্তি কমে যাচ্ছে। জলবায়ু মোকাবেলায় ২০০৯ সালে একটি কর্মকৌশল নির্ধারণ করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীও আমাদের জন্য একটি ফান্ড তৈরি করেছিলেন। আমরা পরিকল্পিতভাবে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
ঢাকা মহানগরী এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলে মাইকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বা অপব্যবহার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ফুটপাতের হকার এবং রাস্তায় চলমান হকাররাও রিকশা অথবা ভ্যানগাড়িতে মাইক লাগিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাজাতে থাকে বিনা বাধায়। মাইকের অবাধ অপব্যবহার চলছে। শ্রবণশক্তি তো ইতোমধ্যেই আরও অনেকের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দেশে ২০ শতাংশ মানুষ বধিরতায় আক্রান্ত। এই ২০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশই শিশু। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক আমাকের জীবনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সারা বিশ্বেই এখন প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু অন্য দেশে আধুনিক প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা আছে, ব্যবহৃত প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার হয়। ফলে প্লাস্টিক সেখানে দূষণ সৃষ্টি করে না। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। এখানে পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করেই রাস্তায়, ড্রেনে, খালে, নদীতে বা জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়। প্লাস্টিক পচে না বা গলে যায় না। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, মাটির উর্বরা শক্তি কমায়, খাল বা নদীর তলদেশে জমা হয়ে মারাত্মক ধরনের দূষণ সৃষ্টি করে। সভ্যতার অবদান প্লাস্টিক আমাদের দেশে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। ২০২১ সালের বায়ুমান সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম ২.৫-এর মাত্রা ৭৬.৯। এর মাত্রা ১০এর নিচে হলে তা ক্ষতিকর নয় বলে বিবেচনা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। ঢাকার চারপাশের ইটভাটায় নিম্নমানের কয়লা পোড়ানো এবং ঢাকা নগরীর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা-ঘাট খোঁড়াখুঁড়ি; রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তূপ, মেরামতহীন ভাঙাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে অতি মাত্রায় বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার নির্গমন, ভবন নির্মাণ ও ভাঙার সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী বাইরে রাস্তা-ফুটপাতে যত্রতত্র ফেলে রাখা, মেশিনে ইট-পাথর ভাঙা এবং শিল্প-কারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালি বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত ক্ষতিকারক গ্যাস, ভারীধাতব কণা ও ধুলাবালি বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথিবীর জলবায়ু প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে গ্রীন হাউস ইফেক্টে। বায়ুদূষণ, যানবাহনে ধোঁয়া। এসবের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এতে করে বরফ গলে সমুদ্রের পানি বেড়ে যাচ্ছে। বন্যা হচ্ছে, টর্নেডো হচ্ছে, এগুলো প্রতিটিই মানুষের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিকর অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে। ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ অনেক বেশি উল্লেখ করে তাদের দাবি, এর ফলে অনেক অসুখ-বিসুখ হচ্ছে। নগরায়ণ এত হচ্ছে যে গাছপালা থাকছে না। প্রতি বছর বিশ্বে ৬০ লাখ হেক্টর বনায়ন ধ্বংস করা হয়, যা বাংলাদেশের অর্ধেক।