করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে বিশ্বের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারাচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। এরই পথ ধরে করোনা ভাইরাসের থাবা পড়েছে দেশের রপ্তানির ৮৪ ভাগ আয় আসা পোশাকখাতেও। দেশের এ খাতে থেমে নেই শ্রমিক ছাঁটাই। যদিও মানবিক দিক বিবেচনায় ঈদুল ফিতরের আগে বড় বড় পোশাক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই কিছুটা কম হলেও একের পর এক বন্ধ হতে থাকে ছোট কারখানাগুলো।
সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয় জুন থেকে। গত ৪ জুন গাজীপুর চন্দ্রায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ ল্যাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেছিলেন, দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো ৫৫ শতাংশ ক্যাপাসিটি নিয়ে কাজ করছে। কারখানার অর্ডার বাতিল হয়েছে। এ অবস্থায় শতভাগ শ্রমিক নিয়ে কাজ করা সম্ভব হবে না। এ কারণে চলতি মাস (জুন) থেকেই শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হবে।
তার এমন বক্তব্যের পর থেকেই মূলত গণহারে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করে কারাখানাগুলো। ড. রুবানা হকের এমন বক্তব্য ব্যাপক সমালোচিত হয়। দেশের সচেতন নাগরিক থেকে শুরু করে শ্রমিক নেতারা তার কঠোর সমালোচনা করে।
শ্রমিক নেতারা বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে বিজিএমইএ সভাপতির এমন বক্তব্য এ শিল্পে অস্থিরতা তৈরি করবে। তার বক্তব্য আগুন ঘি ঢেলে দেওয়ার শামিল। এখন শ্রমিক অসন্তোষের মতো কোনো ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার বিজিএমইএ এবং বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হককে নিতে হবে।
অন্যদিকে সচেতন নাগরিকরা বলেন, কোনো সভ্য দেশে এভাবে ঘোষণা দিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করার কথা কেউ বলতে পারে না। শ্রমিকদের ছাঁটাই না করার জন্য সরকার তাদের প্রণোদনা দিয়েছে। তাহলে লাভটা কী হলো? বাম রাজনৈতিক নেতারা রুবানা হকের সমালোচনা করেন বলেন, বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হকের বক্তব্য ‘দূরভিসন্ধি ও উসকানিমূলক’।
বড় বড় অনেক কারখানা কাজের পরিধি ও অর্ডার কমে যাওয়ার অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিক ছাঁটাই না করে মজরি কিছুটা কমিয়ে শ্রমিক ধরে রাখুন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাজার পরিধি অনেক বেড়ে যাবে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, ওভারটাইম না দিয়ে স্বাভাবিক বেতন দিয়ে হলেও শ্রমিক ধরে রাখতে হবে। একের পর এক শ্রমিক ছাঁটাই হলে এ শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেবে। আর এর দায়ভার শিল্প মালিকদের নিতে হবে।
শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে এ পর্যন্ত ১২৯টি কারখানায় প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। এ বিষয়ে শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বাস্তব তথ্য আরও অনেক বেশি, যেটা প্রায় ৭০ হাজারের বেশি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) তৈরি পোশাকশিল্পে আয় কমেছে ১৯ শতাংশ।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ববাজারে ৩১৮ কোটি ডলারের বেশি ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করেছে ক্রেতারা। এর ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকের জীবিকা এবং পোশাকশিল্পে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশের বহু নামিদামি কোম্পানির কাজ না থাকায় শ্রমিক ছাঁটাই করছে। এ পরিস্থিতিতে পোশাক খাতে ক্যাপাসিটি লস, অর্ডার বাতিল হওয়ায় বহু কারখানা বন্ধ হয়েছে আরও বন্ধ হবে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এক বছরের মধ্যে ২৫ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই হতে পারে, যা প্রায় ১০ লক্ষাধিক।
তিনি বলেন, কাজ না থাকলে মালিকদের পক্ষে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা চালিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। আমরা কোনো ছাঁটাই চায় না, শ্রমিক নিয়ে আমাদের কাজ। তবে কাজ না থাকলে কি করার। এরই মধ্যে কাজ না করেও বসে থেকে দুই মাসের বেতন দেওয়া হয়েছে। কারখানা লেঅফ করে আমরা ৬০ শতাংশ বেতন দেওয়া হয়েছে। কারখানায় কাজ না থাকলে বসে বসে বেতন কিভাবে দেবো।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, একের পর এক শ্রমিক ছাঁটাই অশনিসংকেত এ খাতের জন্য। সঙ্কট কাটাতে কোনো অভারটাইম না দিয়ে শ্রমিকদের স্বাভাবিক বেতনের ব্যবস্থা করতে পারেন মালিকরা। না হলে এ শিল্পে বড় সঙ্কট দেখা দেবে, যার দায়ভার মালিকপক্ষকে নিতে হবে।
এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা আবুল হোসাইন বলেন, সরকারের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক সভার সিদ্ধান্তমতে করোনাকালে শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। কিন্তু মালিকপক্ষ তখন হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেছে এখন আবার ছাঁটাইয়ের কথা বলছেন।
তিনি বলেন, কোনো রকম আইনের তোয়াক্কা না করে মুনাফার আশায় শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। ছাঁটাই করতে হলে তার পাওনা, সুযোগ-সুবিধা দিতে হয় যেটা করা হচ্ছে না। মালিকরা পাঁচ হাজার কোটি টাকার কতো টাকা শ্রমিকদের দিয়েছেন, প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি বলেন, অন্যায়ভাবে শ্রমিক ছাঁটাই মানা হবে না, হতে পারে না। এপরিস্থিতিতে অস্থিরতা দেখা দিলে মালিকপক্ষকে এর দায়ভার নিতে হবে।
ন্যাশনাল গার্মেন্ট ওয়াকার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান বলেন, এখন যে পরিস্থিতি চলছে তাতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সময় এখন না। প্রয়োজনে শ্রমিকের স্বাভাবিক বেতন রেখে ওভারটাইম বাদ দিয়ে শ্রমিক ধরে রাখতে হবে। এটা না করা হলে এ শিল্পে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে, যার দায়ভার মালিকপক্ষকে নিতে হবে। আমরা চাই মানবিক দিক বিবেচনায় পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা আমাদের কথা রাখবেন।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আলী নূর বলেন, যে শ্রমিক আমার বাড়ি-গাড়ি, অর্থ সম্পদ দিয়েছে তাদের কিভাবে এই পরিস্থিতিতে ছাঁটাই করবো। আর ছাঁটাই না করার জন্যতো সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা পেয়েছেন মালিকেরা।
মালিকদের প্রতি শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি তিন মাস ঘরবন্দি। যেদিন আমি বের হবো, নিশ্চয় অনেক কেনাকাটা করবো, আমার মতো আরও সবাই করবে। তখনতো মার্কেট অনেক বড় হবে, আপনার শ্রমিকের প্রয়োজন হবে। এখন ছাঁটাই না করে প্রয়োজনে বেতন কিছুটা কমিয়ে শ্রমিকদের ধরে রাখুন। শ্রমিক বেকার হলে অপরাধ বাড়বে, পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে।