প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানকালের করোনাভাইরাস মহামারির মতো ভবিষ্যতের যেকোনো বিশ্ব বিপর্যয় কার্যকরভাবে মোকাবিলায় ‘আরও বেশি নীতি ও আর্থিক গুরুত্ব প্রদানের’ জন্য বৈশ্বিক সমন্বয়ের আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভবিষ্যতের যেকোনো বিশ্ব বিপর্যয় কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য সমতা বৃদ্ধি এবং সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের মতো স্বাস্থ্য বিষয়গুলোতে আরও নীতি ও আর্থিক গুরুত্ব প্রদানে বিশ্বব্যাপী সমন্বয়ের আহ্বান হিসেবে সবাইকে আমি এই সংকটকে সতর্কতা হিসেবে বিবেচনার আহ্বান জানাব।’
আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক ডা. টেড্রস অ্যাডহ্যানম জিব্রেইসাসকে লেখা এক চিঠিতে তিনি একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকেই তার রীতি অনুসারে বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী সকল দেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে বিশ্বাসী বলেও প্রধানমন্ত্রী তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু সংক্রামক রোগ এবং মহামারি কোনো সীমানাকে সম্মান করে না, তাই আমরা কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধ করতে এবং সার্বিকভাবে জাতিসংঘের মাধ্যমে এবং বিশ্বব্যাপী ডব্লিউএইচও’র মাধ্যমে আঞ্চলিকভাবে সংযুুক্ত হয়েছি। কেননা সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি একটি অভূতপূর্ব সংকট।’
এ সময় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা প্রদানকারী দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা করি যে, এই মহাবিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে ডব্লিউএইচও এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের পাশে থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী এই আপদকালে নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং নেতৃত্বের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি অচিরেই আমরা সম্মিলিতভাবে এই কালো অধ্যায় অতিক্রম করতে সক্ষম হবো।’
প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালের ২৩ মার্চের তার লেখা বিশদ চিঠির জন্য মহাপরিচালককে ধন্যবাদ জানান। যা কোভিড-১৯’র মতো মারাত্মক মহামারির বিশ্ব ঝুঁকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর এবং সম্ভাব্য পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় কর্মকাণ্ডের জন্য ধন্যবাদ জানাতে এবং এই বিষয়ে ডব্লিউএইচও কর্তৃক গৃহীত ভূমিকা ও পদক্ষেপের প্রতি আমাদের দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করার সুযোগ হিসেবে আমি এটিকে গ্রহণ করতে চাই।’
শেখ হাসিনা এ সময় সমগ্র বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তার অব্যাহত ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং নেতৃত্বের জন্যও তাকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, ‘আপনার মতো আমরাও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমরা কোভিড-১৯ এর বিস্তারকে সীমিত করতে এবং এরপর এর সংক্রমণ চেইনকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হবো।’
প্রাণঘাতী ভাইরাস প্রতিরোধে তার সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব প্রচেষ্টা এখন করোনা পরীক্ষা, আইসোলেশনে এবং কোয়ারেন্টাইনে রাখার ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, চীনে করোনা প্রাদুর্ভাবের পরপরই সরকার এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে এবং জাতীয় জরুরি পরিকল্পনা হিসেবে ‘কোভিড-১৯ সংক্রান্ত একটি জাতীয় প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করেছে।
তিনি বলেন, একটি ‘জাতীয় কমিটি’ ও অন্য একটি ‘টেকনিক্যাল কমিটি’র অধীনে ডব্লিউএইচও’র নির্দেশিকা অনুসারে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত আপডেট করা হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এসডিজির মতোই আমরা এখানে অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে সার্বিক সরকারি পন্থা গ্রহণ করেছি। যেমন- কার্যকর সমন্বয়ের জন্য (ক) নজরদারি ও পরীক্ষাগার সহায়তা, (খ) যোগাযোগ সন্ধান করা এবং প্রবেশকালে স্ক্রিনিং, (গ) আক্রান্তদের ব্যবস্থাপনা ও সংক্রমণ প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রণ, (ঘ) ঝুঁকিপূর্ণ যোগাযোগ ও কমিউনিটির সম্পৃক্ততা এবং (ঙ) লজিস্টিকস ও সামগ্রী সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, সরকার জরুরি প্রোটোকল সক্রিয় করতে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাড়া প্রদান ব্যবস্থাপনার সমন্বয় করতে পদক্ষেপ নিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘জাতীয় কমিটি ছাড়াও আমরা আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা এবং নিচের স্তরগুলোতে কমিটি গঠন করেছি যাতে জনগণের প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য পেশাজীবী, প্রশাসন এবং অন্যান্য ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্টদের নিরন্তর নির্দেশনা প্রদান করতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে – যার মধ্যে রয়েছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা, সকল সরকারি ও বেসরকারি অফিস, বাজার (খুব প্রয়োজনীয় বিষয় ব্যতীত) ৪১ দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া এবং এমনকি পবিত্র রমজান মাসেও সব ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা এসব পদক্ষেপের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্বশেষ ব্যক্তির কাছে পৌঁছানোর জন্য বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের জন্য ২৪ ঘণ্টা কাজ করেছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ডব্লিউএইচও’র কড়া নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার ব্যাপক পরীক্ষা ও আইসোলেশন বজায় রাখার ওপর জোর দিচ্ছে এবং সারা দেশে করোনা পরীক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ পরীক্ষার কিট সংগ্রহ করেছে।
তিনি বলেন, ‘যদিও বিপুল জনসংখ্যা ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবুও, আমরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার সারাদেশে নিবেদিত আইসোলেশন কেন্দ্র স্থাপন করেছে, পৃথক হাসপাতাল প্রস্তুত করেছে এবং ম্যানেজমেন্ট প্রোটোকল অনুযায়ী আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে কোভিড -১৯ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী সরবরাহের ঘাটতির মধ্যে আমরা স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই সরবরাহ করতে সফল হয়েছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ডাব্লিউএইচও বিভিন্ন প্রোটোকল ও নির্দেশিকা প্রণয়ন এবং সেগুলো ব্যবহার ও অভিযোজনের জন্য আমাদেরকে প্রদান করেছে, তার জন্য বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ এর প্রতিকূল প্রভাব মোকাবিলায় আমরা স্থানীয় ইউএনআরসি ও ইউএনসিটি-র সঙ্গে সাড়া প্রদান পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনসমাগম এড়াতে সরকার জাতির পিতার জন্মশতবর্ষের বহুল প্রতিক্ষীত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত করেছে। পুরো দেশ এই অনুষ্ঠানের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছিল।
তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ নির্মূল করাই হবে আমাদের জাতির পিতার জন্মশতবর্ষের সময় আমাদের জনগণ ও সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য সেরা উপহার।’
শেখ হাসিনা আরো বলেন, একই সাথে, সকল মিডিয়া বিশেষত সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র ব্যাপক সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি নিজে নিয়মিতভাবে দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছি এবং কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আমার সরকারি ব্যস্ততার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং জনগণের আস্থা জোরদার করার জন্য বাস্তব সময়ে সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়াতে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, খ্যাতিমান চিকিৎসক এবং অন্যান্য পেশাজীবী, সমাজকর্মী ও সিএসওরা সকলেই গণমাধ্যমে প্রচারণা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
বর্তমানে ১৩০টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চলমান রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সব কর্মসূচি ছাড়াও সরকার কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় দেশের দরিদ্র জনগণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে অতিরিক্ত আর্থিক ও খাদ্য সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে সমাজের শ্রমিক ও অনুরূপ দরিদ্র অংশের প্রতি অধিকতর বেশি মনোযোগ দিয়ে আমাদের জিডিপির ৩.৫ শতাংশ ১১.৬০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার পাঁচ কোটি মানুষকে সরাসরি নগদ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে এবং দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য এ পর্যন্ত ছয় লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বব্যাপী এ সংকটের ভবিষ্যত প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলায় নানা উপায়ে কাজ করে যাচ্ছি ‘যাতে কেউ পিছিয়ে না থাকে’। আমি উল্লেখ করতে চাই যে, ১১ লাখ রোহিঙ্গাও আমাদের সামগ্রিক কৌশলে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, দেশের জনগণের সহনশীলতা, ত্যাগ এবং তার প্রতি ও তার সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ওপর আস্থা রাখায় তিনি গর্বিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সংকট মোকাবিলায় সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থা এবং বিভিন্ন ব্যক্তি নগদ অর্থ ও সামগ্রী সহায়তা নিয়ে যৌথভাবে সরকারের সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন।
ভিন্নবার্তা ডটকম/এসএস