ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। গত দুই বছরে তারা অন্তত ৬৫-৭০টি ভুয়া বা দ্বৈত এনআইডি কার্ড তৈরি করেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্যই ভুয়া বা দ্বৈত এনআইডি তৈরি করা হতো। ব্যাংক ঋণ পাশ হলে সেই ঋণের ১০ শতাংশ হারে কমিশন নিতো চক্রের সদস্যরা। রিমান্ডের প্রথম দিনে এসব তথ্য জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনের দুই কর্মীসহ প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্য। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত শনিবার (১২ সেপ্টেম্বর) রাতে মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোড এলাকার ডি ব্লক থেকে নির্বাচন কমিশনের দুই ডাটা এন্ট্রি অপারেটরসহ প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেফতারকৃতরা হলো নির্বাচন কমিশনের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর (৩২) ও আনোয়ারুল ইসলাম (২৬); দুই দালাল সুমন পারভেজ ও মজিদ। এছাড়া আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে এক ব্যক্তি নিজের নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে স্ত্রীর নামে আরেকটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেফতার হন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার রাজীব আল মাসুদ বলেন, আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা কাকে কাকে ভুয়া এনআইডি তৈরি করে দিয়েছিল তা জানার চেষ্টা চলছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই চক্রের মূল হোতা সুমন পারভেজ ও মজিদ। তারা গ্রাহক খুঁজে এনে নির্বাচন কমিশনের দুই কর্মী সিদ্ধার্থ ও আনোয়ারুলের কাছে নিয়ে যেতো। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, তাদের তৈরি করে দেওয়া জাল এনআইডি দিয়ে মিল্টন নামে এক ব্যক্তি সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের পুরানো ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের শাখা থেকে তিন কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ইয়াছির নামে এক ব্যক্তি সিটি ব্যাংকের প্রগতি সরণী শাখা থেকে দশ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। সালেহ আহমেদ নামে এক ব্যক্তি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। আব্দুল মজিদ নামে এক ব্যক্তি এনআরবি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। গ্রেফতার হওয়া আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজেই ভুয়া এনআইডি দিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ৯ লাখ ২৫ হাজার ও সিটি ব্যাংকের নিকেতন শাখা থেকে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই চক্রের মাধ্যমে ভুয়া এনআইডি তৈরি করে আশিক নামে এক ব্যক্তি ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা, জাভেদ নামে এক ব্যক্তি লংকা বাংলার ধানমন্ডি শাখা থেকে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা ও জহুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি মেঘনা ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এরা ছাড়াও বাকি যারা ভুয়া বা জাল এনআইডি নিয়েছে, তারা প্রত্যেকেই কমবেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। সব মিলিয়ে জালিয়াতি করে নেওয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা হবে বলে জানিয়েছেন গ্রেফতারকৃতরা।
আলোচিত এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে একের পর এক নাম বেরিয়ে আসছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই বাছাই করে যারা ভুয়া এনআইডি নিয়েছে তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এই চক্রের এক হোতা সুমন আগে আরএম গ্রুপে চাকরি করতো। মজিদ ছিল ব্যবসায়ী। বছর দুয়েক আগে তারা নির্বাচন কমিশনের গুলশান ও খিলগাঁও কার্যালয়ের দুই ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের মাধ্যমে জাল এনআইডি তৈরির সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। যারা একবার ব্যাংক ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছে তাদের সাধারণত দ্বিতীয়বার কোনও ব্যাংক ঋণ দিতে চাইতো না। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এনআইডির মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতার তথ্য সংরক্ষণ করতো। একারণে এই চক্রটির মাধ্যমে ঋণ খেলাপি অনেকেই ভুয়া এনআইডি তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিত।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই চক্রের সঙ্গে কোনও কোনও ব্যাংকের কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানিয়েছেন, ইয়াছির নামে এক ব্যক্তি সিটি ব্যাংকের প্রগতি সরণী শাখা থেকে দশ লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার সময় ওই ব্যাংকের আরিফ নামে এক কর্মকর্তা ইয়াছিরকে ঋণ পেতে সহায়তা করে। একারণে আসামিদের কাছ থেকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কেউ এই চক্রের সঙ্গে জড়িত কিনা তাও জানার চেষ্টা চলছে।
ডিবি সূত্র জানায়, প্রতারক চক্রের মূল হোতা সুমন ও মজিদ জালিয়াতি করে ঢাকায় গাড়ি বাড়িও কিনেছেন। সুমনের উত্তরায় নিজের ফ্ল্যাট রয়েছে। মজিদের মিরপুরসহ রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট ও গাড়ি রয়েছে। গত দুই বছর ধরে তারা মূলত জাল এনআইডি তৈরির কাজই করতেন।
ভিন্নবার্তা/এসআর