
মোস্তাফিজুর রহমান তারা, রৌমারী (কুড়িগ্রাম) : বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রাম—নয়টি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত এই জেলার বুক চিরে বয়ে চলেছে প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র। ভারতের আসাম, মেঘালয় ও ধুবড়ি হয়ে কালির আলগা ভেদ করে এই নদটি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার যাত্রাবাড়ির উত্তরাংশে প্রবেশ করে বাংলাদেশের মাটিতে। ১০৪৭ নম্বর সীমান্ত পিলার ছিন্ন করে প্রবেশের পর এটি আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হয়ে ১৬টি নদনদীর সঙ্গে মিশে শেষ পর্যন্ত যমুনা-মেঘনার বিশাল জলধারায় মিলিত হয়েছে।
উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার বুক চিরে প্রবাহিত এই নদী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লক্ষাধিক হেক্টর উর্বর ফসলি জমি, ভিটেমাটি ও জনবসতি গ্রাস করেছে। অগণিত মানুষ ব্রহ্মপুত্রের রাক্ষুসে ভাঙনে গৃহহারা হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
ব্রহ্মপুত্র নদটি ছলনাময়ী—সে সময় সময় রূপ বদলায়। শীতে সে শান্ত, ধীর, নমনীয়; তার বুক জুড়ে জেগে ওঠে অসংখ্য দ্বীপচর, যেখানে সাদা কাশফুলের দোলায় মন মাতায় প্রকৃতি। অতিথি পাখিরা আসে খাদ্যের সন্ধানে, বাজে তাদের মধুর সুর। কিন্তু বর্ষায় এই নদই হয়ে ওঠে ভয়ংকর রাক্ষসী। তার উন্মত্ত স্রোত গিলে খায় ঘরবাড়ি, ফসল, এমনকি নববধূর বাসরও রক্ষা পায় না তার আগ্রাসন থেকে।
কুড়িগ্রাম ও চিলমারী অঞ্চল জুড়ে নদীর প্রস্থ প্রায় ১৫ কিলোমিটার, দৈর্ঘ্য কয়েকশ কিলোমিটার। এক কূল ভাঙে, অন্য কূল গড়ে—এ যেন ব্রহ্মপুত্রের চিরন্তন খেলা। শতাব্দীজুড়ে এই নদীর সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে এখানকার মানুষ। তাদের জীবন নদীভিত্তিক—নৌকা বাইচ, মাঝির গান, নদীপাড়ের পিঠাপুলির উৎসব—সবই ব্রহ্মপুত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তবুও আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকে ভাঙনের ব্যথা।
অনেকেই বিশ্বাস করেন, নৌকা বাইচের আয়োজন করলে নদী ভাঙে না—এ এক গ্রামীণ কুসংস্কার। কিন্তু বাস্তবে ব্রহ্মপুত্র তার খেয়াল মতোই এক কূল ভাঙে, অন্য কূল গড়ে। শীতে সে নতুন চর জাগিয়ে দেয়—যার বুকজুড়ে পড়ে থাকে উর্বর ফসলি মাটি, অজানা সম্পদের সম্ভাবনা।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ভান্ডার হতে পারে ব্রহ্মপুত্র
সরকারি অব্যবস্থাপনার কারণে এই বিশাল নদীভূমির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ সামান্য উদ্যোগ নিলেই ব্রহ্মপুত্র হতে পারে দেশের এক বিশাল অর্থনৈতিক সম্পদভান্ডার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত থেকে প্রবাহিত অংশ থেকে রৌমারী-চিলমারী পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার প্রস্থ রেখে নদীর দুই তীর জিওব্যাগ ও কংক্রিট ব্লক দিয়ে মজবুত বাঁধ তৈরি করা যেতে পারে। নদীপথ ড্রেজিং করে নদীর দুই পাড়ে কৃত্রিম চর সৃষ্টি করা সম্ভব, যা পরবর্তীতে লিজের মাধ্যমে আবাসন, পর্যটন কেন্দ্র ও ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই নবজাগ্রত চরাঞ্চল থেকেই গড়ে উঠতে পারে একটি নতুন আধুনিক শহর—‘ব্রহ্মপুত্র নগরী’।
এখানে ৫ কিলোমিটার প্রস্থের নদীপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজ চলাচলের সুযোগ তৈরি হবে। এতে সড়কপথের যানজট কমবে, বাড়বে নৌবাণিজ্য, উন্নত হবে দেশের অর্থনীতি।
নদীর সঠিক ব্যবস্থাপনা হলে আর কেউ ভিটেমাটি হারাবে না, ফসলি জমি রক্ষা পাবে, খাদ্য সংকট কমবে। নদী সংস্কারে সরকারি অর্থ ব্যয়ও হ্রাস পাবে।
ব্রহ্মপুত্রের বুক জুড়ে রয়েছে অগণিত ভূগর্ভস্থ সম্পদ—যা অনুসন্ধান ও ব্যবহারের জন্য একটি “ব্রহ্মপুত্র নদ গবেষণা ইনস্টিটিউট” গঠন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
সঠিক পরিকল্পনা, গবেষণা ও সরকারি মনোযোগ পেলে ব্রহ্মপুত্র একদিন হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রধান উৎস—যেখানে নদী ভাঙন নয়, গড়ে উঠবে আবাসন, কর্মসংস্থান ও খাদ্যের নিশ্চয়তা।
তাহলেই সত্যি হবে—
“নদীতে থাকবে সমাধান, ভাঙনের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে জনজীবন।”