প্রায় এক লাখ আটকে পড়া পাকিস্তানি বসবাস করছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরস্থ জেনেভা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের ঘিঞ্জি পরিবেশে গড়ে উঠেছে বিশাল মাদক সিন্ডিকেট। এটি পুরো রাজধানীর মাদকের আস্তানাও বলছেন অনেকে। এখানে পাঁচ শতাধিক মাদকের স্পট রয়েছে। আর এ নিয়ন্ত্রণ করছেন কানাবাবু, দিলদার, পিচ্ছিরাজা, আলমগীর, কালিম জাম্বু, পারভেজ, মাসুম, রুবেল, উল্টা সালাম, বাচ্চু, খোকন, ভূঁইয়া সোহেল, সৈয়দপুরী বাবু, আরিফসহ একাধিক চক্র। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ আশপাশের বাসিন্দারা। গত আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় এদের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় একাধিক মামলা ও অভিযোগ থাকার পরেও এই চক্রের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে বিহারি মাদক ব্যবসায়ীরা। স্থানীয়রা এমন অভিযোগ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে জেনেভা ক্যাম্প কলেজ গেট এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মো. সনু (৩০) নামে এক রিকশাচালক নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মোহাম্মদপুর থানা থেকে এই মাদক ব্যবসায়ীরা অস্ত্র লুট করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর ওইদিনের সংঘর্ষে এ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। মূলত দুটি মাদক কারবারী গ্রুপের মধ্যে তীব্র বিরোধ থাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে একটি গ্রুপকে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গির কবির নানকের ছত্রছায়ায় ৩২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম এদের সহায়তা করত। আরেকটি গ্রুপকে সহায়তা করত ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার বিশ্বাস। এ গ্রুপের সাথে রয়েছে আলমগীর, পারভেজ, রুবেল, উল্টা সালাম, বাচ্চু, খাকনসহ অনেকে। এরা জেনেভা ক্যাম্পের ১০৮ নং ব্লকে বসবাস করছে। এছাড়া, ব্লক-বিতে মাদক ব্যবসায়ীদের মেধ্যে রয়েছে নাটু-সুমন সাকিনা কসাই-বাবু দিলদার পি বিহারি মাদক ব্যবসায়ীরা পিচ্চি রাজা আলতাফ শনারু-এরশাদ কামরান পাগলা-আজাদ চুওয়া-সেলীম ফকলা-নাসীমওয়াহাব লিটন কান-কামরান সুরাজ বেচু মাছুওয়া-সাঈদ উল্লেখযোগ্য।
এদের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে মাদকের রাজত্ব কায়েম করছেন। শুধু তাই নয় এই চক্রটি নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে। কেউ টাকা দিতে না পারলে মাদক দিয়ে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলাবাহীনির হাতে তুলে দিত। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোন কাজ হচ্ছে না বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
সূত্রমতে, মাদকের আখড়া হিসেবে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের কুখ্যাতি রয়েছে। গত সরকারের সময় দেশব্যাপী জোরদার মাদকবিরোধী অভিযানের সময় এই ক্যাম্পেও কয়েক দফায় বড় অভিযান চালানো হয়। তার পরও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি মাদক ব্যবসা। সরেজমিন দেখা যায়, জেনেভা ক্যাম্প বা বিহারি ক্যাম্পের চারপাশেই নানারকম দোকানপাট। ঘনবসতিপূর্ণ এই ক্যাম্পের ভেতরে প্রচুর অলিগলি। সেগুলোতেও অনেক দোকান। মনে হতে পারে, পুরো ক্যাম্পই যেন একটি মার্কেট! সেখানে প্রচুর লোকজনের আনাগোনা। এমন ভিড়ের মধ্যেই কিছু স্থানে চলছে ইয়াবা, গাঁজা ও হেরোইন বেচাকেনা। ক্যাম্পের বাইরে হুমায়ুন রোড-সংলগ্ন আলফালাহ মেডিকেল এলাকার ডাস্টবিন মোড় তেমনই একটি স্পট। স্থানীয় এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে ওই এলাকায় গিয়ে আলো-আঁধারির মধ্যে কয়েকজনকে মাদক বিকিকিনি করতে দেখা যায়। বিক্রেতার মধ্যে রয়েছে, আলমগীর, রুবেল মটকি সীমা, পাগলা মনু ওরফে লম্বু মনু। পারভেজ ও কলিম এখানকার দুই শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। এভাবে একে একে বেশ কয়েকটি স্পট খুঁজে পাওয়া যায়। ক্যাম্পের অপর এক বাসিন্দা বলেন, ক্যাম্পের নামে নানা অভিযোগ। সবাই বলে আমরা ইয়াবা ব্যবসা করি। আসলে ক্যাম্পের লোকজন যারা ইয়াবা ব্যবসা করে, তাদের ইয়াবা বিক্রি ও খাওয়া শিখিয়েছে এ চক্রটি। এদের নির্মূল করতে পারলে সব সমস্যার সমাধান হবে। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান ‘শুধু ক্যাম্প না। ক্যাম্পের আশপাশে যত ইয়াবা সিন্ডিকেট আছে, সব এরা নিয়ন্ত্রণ করছে। ওদের অনেক ক্ষমতা, তাই কেউ মুখ খুলতে পারে না। তারা নিরীহ লোকদের রাস্তা থেকে ধরে এনে নানাভাবে নির্যাতন করে টাকা আদায় করছে। কেউ টাকা দিতে না পারলে মাদক মামলা দিয়ে পুলিশকে ধরিয়ে দিত। এদের অত্যাচারে আশপাশের বাসিন্দারাও অতিষ্ঠ। বিহারিদের সংগঠন এসপিজিআরসির সভাপতি এম শওকত আলি বলেন, এখানে মাদকের সিন্ডিকেট রয়েছে এটা সত্য। তবে এ মাদক সিন্ডিকেট তো হঠাৎকরে আসেনি। বছরের পর বছর চলে আসছে। ফলে এদের চাইলেও নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। মোহাম্মপুর থানার ওসি ইফতেখার হাসান বলেন, যারা এখানে মাদককের সাথে জড়িত তাদের সবাইকে ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগিরই যৌথ অভিযান পরিচালনা করে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।