বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাপন যেন ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকার, প্রশাসন ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা দিয়ে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে দেশের অধিকাংশ এলাকায়।
তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ পাশাপাশি গণপরিবহণ বন্ধ করে দেয়ার পর দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষজনের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের দিনযাপনও অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়েছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিবিসি বাংলার কাছে যেসব তথ্য এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা নেয়া থেকে বিরত থাকছেন।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সমন্বয় করে এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রাণ, খাদ্যপণ্য ও জরুরি সেবা সরবরাহ করছে।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের প্রভাবে নিয়মিত চাকরিজীবী বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন, কিন্তু দিনযাপন রীতিমতো কষ্টকর হয়ে পড়েছে পরিবহণ শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী, বিভিন্ন ধরণের ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িতদের জন্য।
এমনকি বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরাও – যাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেতন দেয়া হয়নি অথবা চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে – এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে দিনযাপন করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
সহায়তার প্রয়োজন থাকলেও লোকলজ্জার কারণে যারা চাইতে পারছেন না অথবা একাধিকবার সহায়তা চেয়েও পাননি, এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা।
‘২৭ দিনে ৪ কেজি চাল আর ৪০০ গ্রাম পেঁয়াজ’
ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা সুজন বর্মন কাজ করেন পণ্য পরিবহণ করে এমন প্রতিষ্ঠানে। সরকার সাধারণ ছুটি যেদিন ঘোষণা দেয়, সেদিন থেকেই বন্ধ তার প্রতিষ্ঠান।
তিনি জানান, “মালিকপক্ষ অগ্রীম কিছু টাকা দেয়ার পর মার্চের বেতন বা নববর্ষের ভাতা কিছুই দেয়নি। এখন তো মনে হচ্ছে ছুটি আরো বাড়লে এপ্রিল মাসের বেতনও পাবো না।”
সুজন বর্মণের বাড়িতে সদস্য মোট ছয় জন – যার মধ্যে তিনি এবং তার মা হলেন উপার্জনক্ষম। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর তার মা-ও কাজে যেতে পারছেন না। ফলে দারুণ সঙ্কটে পড়েছে তার পুরো পরিবার।
সুজন বর্মন জানান, এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জরুরি খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা চেয়ে সরকারি হটলাইনে ফোন করেছেন তিনি, তবে সাহায্য পেয়েছেন মাত্র একবার।
“গত ২৭ দিন ধরে কোন কাজ নেই – এর মধ্যে আমাদের ছয় জনের পরিবারের জন্য পেয়েছি চার কেজি চাল আর ৪০০ গ্রাম পেঁয়াজ।”
বিপাকে প্রাইভেট টিউশন করে খরচ চালানো শিক্ষার্থীরা
গ্রাম বা মফস্বল থেকে বিভিন্ন শহরে পড়াশোনা করতে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিপদে পড়েছেন এই সাধারণ ছুটির সময়। আবাসিক হলে বা বাসা ভাড়া করে থাকা এই শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ তাদের খরচ সামলান শিক্ষার্থী পড়িয়ে।
কিন্তু অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার ফলে তাদের উপার্জনের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের দিনযাপন।
ঢাকার মগবাজার এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রী টিউশনি তার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নানাবিধ সমস্যায় পড়েছেন।
এতদিন ওই শিক্ষার্থী চাকরির আবেদন করার পাশাপাশি খরচ চালাতে টিউশনি করতেন। কিন্তু এখন আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন খাবারের খরচ জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
আবার সঙ্কোচের কারণে সরকারি সহায়তাও চাইতে পারছেন না তিনি।
একই সমস্যায় রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি কলেজে অনার্স পড়তে থাকা আরেক ছাত্র। কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দু’টি টিউশনিসহ আরেকটি পার্টটাইম কাজ করতেন তিনি, কিন্তু এখন কোনটিরই বেতন পাননি।
তার বাড়িতে পরিবহণ খাতে যুক্ত বাবার কাজ বন্ধ থাকায় পুরো পরিবারই পড়েছে খাদ্য সমস্যায়। কিন্তু মধ্যবিত্ত মানসিকতার বাধা পেরোতে না পেরে তার পরিবারও ত্রাণ সহায়তা চাওয়ার চেয়ে ক্ষুধা নিয়েই দিনযাপন করে যাচ্ছেন।
দুরাবস্থা তৃণমূলের খেলোয়াড়দের
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের সব মেগা স্পোর্টস ইভেন্ট যেমন বন্ধ হয়ে গেছে, তেমনই স্থবির হয়ে গেছে বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়ের ছোট ছোট খেলাধূলার আসরও। ফলে আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার তৃণমূল পর্যায়ের খেলোয়াড়রা।
যশোরের একজন তরুণ নারী বক্সার অপেক্ষা করছেন সরকারি সহায়তা পাওয়ার। সম্প্রতি কিছুদিন আগে তার বাবা তাকে এবং তার মা’কে ত্যাগ করেন।
আর্থিক সঙ্কটে থাকা অনেক খেলোয়াড়কে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ক্রীড়া বিভাগের পক্ষ থেকে নানা ধরণের সহায়তা দেয়া হলেও এই নারী বক্সারের মত অনেকেই এখনও কোনো সহায়তাও পাননি, এবং অনেকে সহায়তা চানওনি।
বিভিন্ন জেলা কার্যত ‘লকডাউন’ করার সপ্তাহখানেক পরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতি উত্তরণে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেন।