জলাবদ্ধতায় ভুগছেন গরবাসী। রাস্তাজুড়ে থইথই পানি, কর্মব্যস্ত মানুষের চলাচলে সৃষ্টি হচ্ছে অন্তহীন প্রতিবন্ধকতা। পানি ও তরল বর্জ্য নিষ্কাশনে ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরি করা হলেও সে ব্যবস্থাই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড্রেনগুলো সচল না থাকায় আটকে যাচ্ছে পানি। এছাড়াও বিভিন্ন সেবা সংস্থা অপরিকল্পিত খোঁডাখুঁড়ি বাড়িয়েছে দুর্ভোগ। হাঁটু পানির জলাবদ্ধতা যাচ্ছে কোমড় পানির দিকে। বৃষ্টি একটু বেশি হলেই সড়কে নৌকা চলার জোগাড়। পানি ভেঙে চলতে গিয়ে যানবাহন পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়। তাই একমাত্র ভরসা রিকশাতে চড়তে গিয়ে খানাখন্দে ভরা সড়কে যাত্রীদের উল্টে-পল্টে পড়ে কাদাপানিতে একাকার হয়ে যান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম খালগুলো অবৈধ দখল ও কঠিন বর্জ্যে ভরাট হয়ে আছে। এছাড়াও ড্রেন, বক্স কালভার্ট ও ব্রিক স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে পানি নদীতে যেতে পারছে না। অপরি”ছন্ন ও দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণেই ফলে ভারি বর্ষণে শহরের অলিগলি, প্রধান সড়ক, ফুটপাত পর্যন্ত তলিয়ে যায়। এ সময় খানাখন্দে ভরা সড়কে চলাচলে প্রতি বছরই হতাহতের ঘটনা আছেই। কিন্তু তারপারেও জলাবদ্ধতা সমাধানে তুলনামূলক নজর কম সিটি কর্পোরশনের। কিন্তু ওয়াসা ড্রেনেজ প্রকল্পে প্রতি বছর খরচ করছে কোটি কোটি টাকা।
আজ মঙ্গলবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত মুষলধারে চলতে থাকা টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে পানি জমে দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। কোথাও পানির স্রোত গিয়ে তলিয়ে গেছে দোকান পাট ও ঘরবাড়িতে। সোমবার সকাল থেকেই বৃষ্টতে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক তো বটেই, বিভিন্ন সংযোগ সড়কেও পানি জমে গেছে।
সড়কে নেমে অফিসমুখী নগরবাসী দুর্ভোগে পড়েন। অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজে, পানি মাড়িয়ে গন্তব্যে ছুটেছেন। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে যানবাহনও বিকল হতে দেখা গেছে। বেশিরভাগ রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় শুস্ক রাস্তায় সব গাড়ি ঢোকায় বিভিন্ন এলাকায় ছিলো তীব্র যানজট। এছাড়া বিভিন্ন বাসা-বাড়িতেও পানি উঠলে ঘরের জিনিসপত্র তাড়াহুড়া করে বের করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেছেন অনেকেই।
ধানমন্ডি ২৭, সংসদ ভবন এলাকা, লালমাটিয়া, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া, তেজকুনিপাড়া, তেজতুরি বাজার, মিরপুর ১০ থেকে ১৪ নম্বর, তেজগাঁও, সাতরাস্তা মোড, কারওয়ানবাজার টিসিসি ভবন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উত্তর গেট, নয়াপল্টন, পুরান ঢাকার বঙ্গবাজার এলাকা, সিদ্দিক বাজার মোড়, নাজিরা বাজার, নাজিম উদ্দিন রোড, গ্রিন রোড, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, শুক্রাবাদ, রামপুরা, মালিবাগ ও খিলক্ষেতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন পথচারী ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা।
মিরপুর কাজীপাড়া এলাকায় ১ তলা পাকা ঘরে বাস করা রাজু বলেন, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরের মধ্যে হাটু সমান পানি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তারাহুড়া করে ঘরের ইলেকট্রনিক জিনিস গলো ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়েছি।
পুরানঢাকার রিকসা চালক রহমত আলী বলেন, এমনি করোনায় ঘরে খাওয়া নাই, বেশিরভাগ রাস্তায় পানি। সারাদিনে মোটে ১৮৬ টাকা পাইছি। এই পানি কয়দিন থাকে কে জানে।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে সর্বমোট ২৫০০ কিলোমিটার খোলা ড্রেন এবং ৪০০০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যবস্থাপনা করে আসছে৷ গত চার বছরে ৩০৩ কোটি টাকারও বেশি খরচ করা হয়েছে ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়নে। ঢাকা ওয়াসা ‘স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে তবে তা কবে শেষ হবে নিশ্চিত নয়৷
দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে জলাবদ্ধতা বেশি উত্তর সিটিতে। ১৯ টি এলাকাকে এর মধ্যেই অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে সনাক্ত করেছে ডিএনসিসি। এর মধ্যে কারওয়ান বাজার, মিরপুর, কালশী, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলখেতসহ বিভিন্ন এলাকা অন্যতম।
অন্যদিকে ১১ টি এলাকা ঝুকিপূর্ন সনাক্ত করেছে দক্ষিণ সিটি। এখানকারা পূর্ব জুরাইন থেকে ডিএনডি বাঁধ পর্যন্ত এলাকায় বছরের প্রায় প্রতিদিনই পানি জমে থাকে। গত বছর জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি কর্পোরেশন প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অত্যাধুনিক ‘জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন’ কিনেছিলো। এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারে বলে দাবি করা হয়েছিলো কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে। এমনকি প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করতে সক্ষম। কিš‘ বাস্তবে এর কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না।
বৃষ্টি শুরুর পরই জলাবদ্ধতা দূর করতে দুই সিটি কর্পোরেশন তার কাউন্সিলর ও পরি”ছন্নতা পরিদর্শকদের সমন্বয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে কমিটি গঠন করা হয়েছিলো ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’ নামে ওই কমিটিতে ১০ জন করে সদস্য আছে। সে হিসেবে দুই সিটির ৯১টি ওয়ার্ডে ৯১০ জন কর্মী থাকার কথা৷ বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা হলেই এসব কর্মী মাঠে নেমে ড্রেন ও ম্যানহেলগুলোর ঢাকনা খুলে দেবে। একই সঙ্গে বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নিতে হলে তাও করবে। কিন্তু জলাবদ্ধতা হলে এসব কর্মীর কোনও অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না।
জানা গেছে, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিআরটি প্রকল্পের উন্নয়ন কাজের কারণে রাজধানীর অনেকাংশে পানি নিষ্কাশন ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে এবারের বর্ষায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহরূপ ধারণ করতে পারে। মেট্রোরেলের উন্নয়ন কাজের কারণে মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও তালতলা পর্যন্ত ওয়াসার ড্রেনেজ সিস্টেম এর মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়েছে। এগুলোর সংস্কার এখনও শুরু হয়নি। এছাড়া বিজয় সরণির ‘বিমান চত্বর’ থেকে খামারবাড়ি হয়ে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়েছে। ওই ড্রেনেজ সংস্কার করে দেয়ার জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। এতে তারা সিটি কর্পোরেশনকে ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো পর্যন্ত কোন টাকা পায়নি উত্তর সিটি।
জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ গত বছর থেকেই শুরু করেছিলাম। নতুন করে দায়িত্ব নেয়ার পরে এ কাজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছি। পানি নামার লাইন গুলোর সংস্কারের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে আশকোনায় একটি খাল উদ্ধার হয়েছে। তিনি বলেন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের যেসব পথ রয়েছে সেগুলো একেকটি একেক সংস্থার। এখন অন্য সংস্থাগুলো তাদের মালিকানাধীন খাল বা নালা সচল রাখতে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যে কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
ওয়াসার বিরুদ্ধে অভিযোগ মেয়র করে বলেন, ড্রেন পরিস্কারের দায়িত্ব থাকলেও সেদিকে তাদের নজর নেই। ড্রেন পরিস্কার করবে না বলেই তারা জানিয়ে দিয়েছে। অন্য সংস্থার খালে এবং ড্রেনও আমাদের পরিষ্কার করতে হচ্ছে। অথচ তারা আমাদের কোনও টাকা দিচ্ছে না। যার ফলে নিজেদের প্রজেক্টের কাজ গুলো করতে বিলম্ব হচ্ছে।
সেবাসংস্থা গুলোর ঠেলাঠেলি: সেবাসংস্থাগুলোর ঠেলাঠেলির কারনে চলতি বর্ষার আগে বেশির ভাগ ড্রেনই পরিষ্কার করা হয়নি। যার কারনে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হতে পারছে না। তা ছাড়া মাটিতে রিচার্জসহ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার পুরো নেটওয়ার্ক ছিন্নভিন্ন অবস্থায় রয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন পরিষ্কারের কাজ। ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, সিটি করপোরেশন নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করে না। ময়লা আবর্জনাও ঠিকমতো অপসারণ করতে পারে না। এসব ময়লা গিয়ে ওয়াসার ড্রেনের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। করপোরেশনের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ওয়াসা তাদরে বক্স কালভার্ট ও স্টর্ম স্যুয়ারেজ ড্রেন পরিষ্কার রাখে না। ফলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এসব বিষয় নিয়ে সেবা সংস্থাগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিরাও একে অন্যের প্রতি বিষোদগার করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপেও কোনো সমাধান হয়নি।
এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৗশলী রেজাউর রহমান বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা যেসব পয়েন্টে কাজ করছিলাম তা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে সচিবালয় ও মতিঝিল, এলাকায় ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় আমাদের কাজ চলছে। করোনাভাইরাসের কারণে কাজ কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন মূলত সেকেন্ডারি কাজ করে থাকে। প্রাইমারি কাজ করে ওয়াসা। ওয়াসা যদি তাদের কাজ ঠিকমতো করে, তাহলে জলাবদ্ধতা হবে না।
ডিএসসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়াসার বোর্ড মেম্বার হাসিবুর রহমান মানিক বলেন, স্যুয়ারেজ লাইন পরিষ্কারের দায়িত্ব ওয়াসার । আগে তারা একেবারেই কাজ করতো না কিন্তু কিছুদিন আগে ২.৯ প্রজেক্টের কাজ চলছে। শেষ হতে ৩ মাস সময় লাগবে। এ কারনেই পুরান ঢাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, কমলাপুর রেল ষ্টেনের নিচে একটা বাঁধ রয়েছে যেখানে সব ময়রা আটকে থাকে। ওটা খুলে দিলেই দক্ষিন সিটির জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে যাবে। এ বিষয়ে ওয়াসাকে বলা হয়েছে। এছাড়াও ওয়াসার পরিস্কার কর্মীর ঘাটতি রয়েছে। যারা আছেন তারা ইঞ্জিনিয়ার তারা ড্রেনে হাত ঢুকিয়ে ময়লা পরিস্তার করতে পারেন না। তাই প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়াসার ৫-৬ জন করে পরিচ্ছন্ন কর্মী দেয়ার দাবি করেন মানিক।
জলাবদ্ধতা নিরসনে নেই টেকসই উদ্যোগ: জলাবদ্ধতার ঝুঁকি দিনকে দিন বাড়লেও টেকসই সমাধানে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। শুধু মিটিং আর নির্দেশেই আটকে আছে এ সংক্রান্ত কাজ। এ বিষয়ে কর্মপš’া নির্ধারণে শেষ গত ফেব্রুয়ারিতে সচিবালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগে একাধিক সভা হয়। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হলেও কাজ শুরু হয়নি আজও।
স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এবারের বর্ষায় ঢাকায় যেনো জলাবদ্ধতা না হয় সেজন্য ঢাকার দুই সিটিকে দুই সিটি কর্পোরেশনকে দুটো প্রকল্প গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে শহরের দখলদার উচ্ছেদ করে জলাবদ্ধতার টেসই সমাধান মিলবে বলে আশাকরি।
ভিন্নবার্তা ডটকম/এনএন