বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা নির্দেশকারী গ্রাফটি যখন কেবলই ঊর্ধ্বমুখী, তখন বন্ধ থাকা কলকারখানা, দোকানপাট, অফিস-আদালত খুলে দেওয়ার তোড়জোড় ভাবিয়ে তুলেছে মহামারি বিশেষজ্ঞদের। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী গত ৮ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ৭,৬৬৭ জন মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার আক্রান্ত হয়েছেন ৫৬৪ জন। আর এর আগের দিন বুধবার আক্রান্ত হন ৬৪১ জন।
গত কয়েক দিনের আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যায় খানিকটা ওঠানামা থাকলেও প্রতিদিনই অন্তত কয়েকশো’ মানুষ এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
আর এই পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে অধিকাংশ গার্মেন্টস কারখানা খুলেছে, দোকানপাটে মানুষ আরও বেশী সময় ধরে কেনাকাটা করতে পারছেন, সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে কিছু সরকারি দপ্তর। কিছু মন্ত্রণালয় এবং আদালতের কার্যক্রম সীমিতভাবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও পরে তা অবশ্য বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছাতে বরং আরো খানিকটা সময় নেবে।
আক্রান্তের সংখ্যা
ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, আক্রান্তের সংখ্যা কেবল এই ধারণাই দিচ্ছে যে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। তিনি বলেন, “২৫ তারিখ থেকে বেড়েই চলেছে। আজকে (বৃহস্পতিবার) কিছুটা কমেছে। কালকে আবার কমবে নাকি বাড়বে বলা যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “গত কয়েক দিন ধরে সংক্রমণের কাউন্ট উঠেই চলেছে। আর পুরো বাংলাদেশে একদিনে যদি সংক্রমণের সংখ্যা ৬০০ হয়, তাহলে দেখা যায় যে শুধু ঢাকা শহরেই হয় চারশো’। এই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।”
এর আগে বিশেষজ্ঞরা বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন যে বাংলাদেশে মার্চ এবং এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যে ব্যবস্থাগুলো নেয়া হয়েছিল, সেগুলোর একটি প্রভাব দেখা যাবে মে মাসে।
তারা এ-ও বলেছিলেন, মে মাসের প্রথম দিকে সংক্রমণের পিক (সর্বোচ্চ সংক্রমণের সংখ্যা) পাওয়া যাবে না, বরং এটি আরও প্রলম্বিত হবে। তারা আশঙ্কা করেছিলেন যে, মে মাসটি বাংলাদেশের জন্য ‘ক্রিটিক্যাল’ হতে পারে।
আর এমন আশঙ্কার মধ্যেই যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে গত এক মাস ধরে যে ‘লকডাউন’ সারা দেশে ছিলো, তা কিছুটা শিথিল হয়ে আসছে।
তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানাগুলো খুলে দেয়া যেমন এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, তেমনি রয়েছে ঢাকার রেস্তোরাগুলোকে ইফতারি বিক্রির অনুমোদন দেয়া।
প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের যে সংখ্যা জানানো হচ্ছে, তা সম্ভবত বাংলাদেশে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র নয়। এ বিষয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর)-এর ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান তাহমিনা শিরীন বলেন, অনেক মানুষ রয়েছে যাদের শরীরে ভাইরাস থাকলেও উপসর্গ নেই। কিন্তু পরীক্ষা করার পর তিনি চিহ্নিত হচ্ছেন ভাইরাসবহসকারী হিসেবে, বলছিলেন তাহমিনা শিরীন।
তিনি জানান, অনেক অসুস্থ মানুষ রয়েছেন যাদের পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু তারা পরীক্ষা করাতে পারছেন না, কারণ পরীক্ষা করানোর মতো সুযোগ নেই।
একমাত্র আইইডিসিআর-এর পক্ষে পুরো বাংলাদেশ তো দূরের কথা শুধু ঢাকা শহরের সব মানুষের করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করাও সম্ভব না বলে মন্তব্য করেন তিনি। সেই সাথে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা কিছুটা জটিল মলিকিউল টেস্ট হওয়ার কারণে দক্ষ জনবল না বাড়াটাও একটা বড় কারণ বলে মনে করেন তিনি।
“এই যে ছয়শো’ আক্রান্তের কথা বলা হচ্ছে, প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে আরো অনেক বড় হতে পারে। কারণ আমরা কি টেস্ট বাড়াতে পেরেছি? কিংবা যাদের আসলেও দরকার তারা পাচ্ছে না।”
শুরুতে কেবলমাত্র আইইডিসিআর করোনাভাইরাসের টেস্ট করলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি পরীক্ষার সক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে। বৃহস্পতিবারে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে সারা দেশে এখন ২৯টি ল্যাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদও বলেন যে সংক্রমণের যে হিসাবটি পাওয়া যাচ্ছে, তাতে তার মনে হচ্ছে না যে সংক্রমণের সঠিক চিত্রটা প্রতিফলিত হচ্ছে।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “হিসাবটা প্রতিনিয়ত দ্বিগুণ করে বা দ্বিগুণের কাছাকাছি করে একটা পর্যায় পর্যন্ত যাওয়ার কথা। সেটা যেহেতু হচ্ছে না, তার মানে হচ্ছে কিছু একটা মিস হয়ে যাচ্ছে।”
লকডাউন কি ঠিক সময়ে দেয়া হয়েছিল?
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে প্রায় পুরো বিশ্ব যে পদ্ধতিটির বিষয়ে একমত ছিলো, তাহলো লকডাউন আরোপ করা। শুরু করেছিল চীন, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল করোনাভাইরাসের। এরপর বিশ্বের বেশীরভাগ দেশই এক্ষেত্রে চীনকে অনুসরণ করে। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয়ভাবে লকডাউন না বলে দেয়া হয়েছিল ‘সাধারণ ছুটি’।
কিন্তু গণপরিবহন, কলকারাখানা এবং অফিস-আদালত বন্ধ আর স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার কারণে কার্যত তা ছিল লকডাউনই। আর স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশের অনেক জেলায় আনুষ্ঠানিকভাবেই লকডাউন আরোপ করা হয়েছিল করোনাভাইরাসের রোগী চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা লকডাউনের বিষয়ে যে প্রশ্নটি তুলেছেন সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশে কার্যকর কোন লকডাউন আদৌ কখনো ছিল কি-না? তাদের অনেকেই বলছেন, একেবারে নামে মাত্র ‘লকডাউন’ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু মানুষ আসলে তা মানেনি। তবে আবার এমন মতও রয়েছে যে ঠিক সময় লকডাউন দেয়া হয়েছিল বলেই সংক্রমণের হার এখনো মারাত্মক পর্যায়ে যায়নি।
এ বিষয়ে ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম বলেন, “আমরা লকডাউন দিয়েছি কাগজে কলমে, কিন্তু লকডাউন মানছি না। তার মানে হচ্ছে, আমরা লকডাউন করি নাই। এর কারণেই আধা-খেঁচড়া ধরণের কাজ হচ্ছে।”
তার মতে, উল্টো এর কারণে কাজও বন্ধ থেকেছে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার মানুষ পুরোপুরি ঘরেও থাকেনি। তবে পুরোপুরি লকডাউন কার্যকর করা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।
লকডাউন কার্যকর হয়নি বলে মত দিয়েছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর)-এর ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান তাহমিনা শিরীনও।
তিনি বলেন, যখন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল তখন সবাই গ্রামে চলে গেলো। তখন সংক্রমণের একটা ঝুঁকি ছিল। বলতে গেলে তখনই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
একই ভাবে গার্মেন্টস খুলে দেয়ার কারণেও মানুষ যখন আবার ঢাকামুখী হয়, তখন একই ধরণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তাহমিনা শিরীন মনে করেন, কোন সময়েই আসলে লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়নি। তবে এ বিষয়ে কিছুটা ভিন্ন মত দিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ। তিনি বলেন, লকডাউন আরোপ করার কারণেই সংক্রমণ কিছুটা কম হয়েছে। তিনি বলেন, “সরকার যে লকডাউন করেছিল তার একটা বড় প্রভাব পড়েছে সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে। কারণ অন্য মিডিয়াগুলো কিন্তু আমাদের খুব একটা কার্যকরী ছিল না।” তবে লকডাউন আরো ভালভাবে কার্যকর করা যেতো বলেও মনে করেন তিনি।
শিথিলতায় কতটা ঝুঁকি বাড়বে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ বাড়ার এই সময়টাতে হঠাৎ করে যদি লকডাউনের শর্ত শিথিল করা হয়, তাহলে ঝুঁকি বাড়বে বৈ কমবে না। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী রয়েছে. ফলে এই শহরে এ ধরণের ঢিলেঢালাভাবে লকডাউন কার্যকর রাখা হলে অনেক বেশি ঝুঁকি বাড়বে।
তিনি বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দরকার হলে এর জন্য একটা টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যারা কেবলমাত্র এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে। “কারণ মানুষ লকডাউন করলেই ঘরে থাকছে না, সেখানে শিথিল করা হলে মানুষ আরও উৎসাহ নিয়ে আগাবে। যেভাবে চলছে, তাতে খারাপ একটা অবস্থা হতে পারে”।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, যেসব এলাকায় গার্মেন্টস রয়েছে – যেমন ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ – সেসব এলাকায় কারখানা মালিকেরা স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশনাগুলো মানছে কি-না, তা তদারক করার কোন উপায় নেই।
তিনি বলেন, কারখানা মালিকেরা যদি শর্ত না মানেন, তাহলে সংক্রমণের হার অনেক বেড়ে যেতে পারে। আইইডিসিআর-এর ভাইরোলজিস্ট তাহমিনা শিরীন বলেন, “লকডাউন কার্যকর না হওয়ার কারণে আমরা অর্থনৈতিকভাবেও লুজার (ক্ষতিগ্রস্ত) হলাম। আবার সংক্রমণও কমাতে পারলাম না।” তিনি বলেন, রেস্তোরায় ইফতারি বিক্রির অনুমোদন দেয়াটা ছিল অবাক করার মতো।
“আমি জানি না কেন ইফতারির দোকান কেন খুলে দেয়া হচ্ছে? এগুলো তো অবশ্যই সংক্রমণ বাড়াবে। এমনিতে উপসর্গ নেই, কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে এমন রোগীতে ভরে গেছে,” তিনি বলেন।
ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, “লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যদি এ বিষয়ে সুপরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নেয়া যেতো, তাহলে গত এক মাস যে কষ্ট করা হলো, তার সুবিধাটা ঘরে তোলা যেতো”।
আর এই সময়ে লকডাউন শিথিল করার পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে ‘ব্যাপক হারে ঝুঁকি তৈরি হলো’ বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এটা ঠিক যে সব সময় লকডাউন রাখা যাবে না। কিন্তু সেটি শিথিল করতে হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শের পর শর্ত মেনে করা উচিত ছিল। কারাখানা বা রেস্টুরেন্ট খুলে দেয়া হলেও যারা সেখানে কাজ করবে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে ছয়টি শর্ত রয়েছে লকডাউন শিথিল করার জন্য তার প্রথমটি হচ্ছে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে এরকম নজীর থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টোটা হচ্ছে। কারণ সংক্রমণের সংখ্যা এখন প্রতিদিনই বাড়ছে।
“বাংলাদেশ এখন এক্সপোনেনশিয়াল পর্যায়ে আছে। এখানে এখন (সংক্রমণ) প্রতিনিয়তই বাড়বে।” ড. আহমেদ বলেন, এক্ষেত্রে আরও যে ৫টি শর্ত রয়েছে, তার কোনটিই বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না। তাই বলা যায়, লকডাউন আগে আগে প্রত্যাহার করা হলে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়বে। “এখন আমাদের তাঁকিয়ে থাকতে হচ্ছে যে সামনের দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে, মে মাসে কী হতে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।