পথে পথে সাপ ও বানরের খেলা দেখিয়ে যা আয় হত তা দিয়ে আমার ও আমার পরিবারের খাবার যোগাতাম। যেখানে যেতাম সেখানে বাঁশের কঞ্চি আর পলিথিনের তৈরি ছোট্ট একটি তাবুতে আশ্রয় নিতাম। ঝড় বৃষ্টিতে ভিজতাম। অনেক কষ্টের জীবন ছিল। এখন নিজেদের জমি আর পাকা ঘর হয়েছে। এখন আর ঘরের চিন্তা নেই। স্বামী সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্তে বসবাস করছি। আমাদের একটি স্থায়ী ঘরের স্বপ্ন ছিল, আজ তা সত্যি হয়েছে। এভাবেই বলছিলেন ঝিনাইদহে কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার “স্বপ্ননীড় আশ্রয়ণ প্রকল্পের” ৫৯ বেঁদে পরিবারের সদস্য গৃহবধু পুতুল। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহারের ঘর তাকে দেওয়া হয়। বেঁদে স¤প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে সরকারের উদ্যোগে ২০২২ সালের ২১ জুলাই ঝিনাইদহে কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জগন্নাথপুর গ্রামের মাজদিয়া বাঁওড়ের ধারে বেঁদে সম্প্রদায়ের বসবাসের জন্য স্থায়ী ঘর ও জমির দলিল বুঝিয়ে দেওয়া হয়। দেশের ইতিহাসে বেদে স¤প্রদায়ের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় স্থায়ী পল্লী। তাদের ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে পল্লিটি নির্মাণ করা হচ্ছে জলাধারের পাশেই। ঘরের চারপাশে কিছু খোলা জায়গা রাখা হয়েছে।
পল্লীর প্রতিটি ঘরের সামনে এখন সবজি চাষ করছেন তারা। সবুজ সবজি আর ফুলে ফলে ভরে উঠেছে প্রতিটি বাড়ির চারপাশ। যে সবজি নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি করে অর্থও আয় করছেন তারা। বৃহস্পতিবার (২৫ মে) সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল “স্বপ্ননীড় আশ্রয়ণ প্রকল্পের” ওই বেঁদে পল্লীটি পরিদর্শনে করেন। দলটির নেতৃত্ব দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক সরকার ও উপসচিব মোহাঃ রফিকুল ইসলাম। এসময় উপস্থিত ছিলেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার, স্থানীয় সরকারে উপ-পরিচালক মোঃ ইয়ারুল ইসলাম, ঝিনাইদহ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রাজীবুল ইসলাম খান, ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া জেরিন, কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান, কালীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ হাবিবুল্লাহ ও বারোবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ উপজেলা প্রশাসনের দপ্তর প্রধানরা। বিধবা কাঞ্চন বিবি’ জানান, বাঁশের ফালি, কঞ্চি আর পলিথিন দিয়ে তৈরি ছোট্ট ঘরে কেটে গেছে জীবনের ৫৫ বছর। স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়ে ফুলমতিকে নিয়ে জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে পথে পথে। বাড়ি বাড়ি হাতের কারসাজিতে খেলা দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে উপার্জিত সামান্য আয়ে মিটিয়েছে মা-মেয়ের পেটের ক্ষুধা। এমন অনিশ্চিত জীবনে স্থায়ী জমি আর ঘরের স্বপ্ন ছিল একেবারেই কল্পনাতিত। আমাকে দুই শতক জমির উপর নির্মিত দুইটি রুম, রান্না ঘর ও একটি টয়লেট দেওয়া হয়। এখন আমার জীবনে আর কোন দুঃখ নেই বলে যোগ করেন।
বেঁদে পল্লির সরদার হাবিবুর রহমান জানান, আমাদের বেঁদে সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক পরিবার আছে ভূমিহীন। যে সব পরিবার তাদের সদস্যদের নিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াই। সাপের খেলা, ম্যাজিক আর ভিক্ষার উপার্জনে যাদের সংসার চলে। বাঁশের ফালি, কঞ্চি আর পলিথিনের তাবুই তাদের ভরসা। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এসব পরিবারের কষ্টের সীমা থাকে না। এরকম পরিবারের জন্য সরকার পাকা ঘর দিয়েছে। এখন এসব পরিবার স্থায়ী মাথা গুজার ঠাই পেয়ে খুশি। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া জেরিন বলেন, বেঁদে স¤প্রদায় কালীগঞ্জ উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছিল। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রæতি মোতাবেক উপজেলা প্রশাসন কালীগঞ্জ বেঁদে স¤প্রদায়ের ৫৯ পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়। জলাধারের সঙ্গে তাদের যে জীবনযাপন ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি পরিবেশ নির্ধারণ করা হয়। পিছিয়ে পড়া এ সম্প্রদায়ের সদস্যদের পুনর্বাসন সম্পন্ন হওয়ায় তাদের নতুন প্রজন্ম শিক্ষা স্বাস্থ্যের পাশাপাশি নাগরিক সুবিধা গ্রহণ করে একটি উন্নত প্রজন্ম গড়ে উঠবে বলে যোগ করেন। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে বিশে^র বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে তুলে ধরেছেন। তারই অংশ হিসাবে সারা দেশের ভূমিহীন গৃহহীন মানুষকে নিশ্চিত ঠিকানা করে দিয়েছেন। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া বেদে সম্প্রদায়ের জন্য স্থায়ী বিশাল এ নিবাস জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সম্ভব বলে মন্তব্য করেন এ সাংসদ।
ভিন্নবার্তা/এমএসআই