দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দীর্ঘমেয়াদী হওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ভাইরাসটির সংক্রমণ শীতকাল পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।
পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ শহর থেকে দ্রুত গ্রাম এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এটা দীর্ঘায়িত হলে গ্রামের পরিস্থিতি শহরের থেকে কয়েক গুণ বেশি ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে বাাংলাদেশ বিশ্বের অধিক সংক্রমিত দেশগুলোর তালিকায় চলে এসেছে। গত ৫ মাস ধরে চলে আসা সংক্রমণের মাত্রার ক্রমেই ঊর্ধ্বগতি হয়েছে। এই গতি সহসাই থামার লক্ষণ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। কারণ, সংক্রমণ এখন দ্রুত শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। কোরবানির ঈদের পর এর আরো বিস্তার ঘটা এবং সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে আগামী শীতকাল পর্যন্ত সংক্রমণ গড়ানোর আশঙ্কাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে গত তিন সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের মাত্রা সামান্য ওঠা-নামা করলেও এটা এখনো ঊর্ধ্বগতিতেই রয়েছে। এই সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে সংক্রমণ হচ্ছে ধীরগতিতে। তবে এতে আত্মতৃপ্তির কোনো কারণ নেই। মুলত করোনা পরীক্ষা কম হওয়ার কারণে সংক্রমণ কম মনে হচ্ছে। এই মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। সেটা এই ঈদের পরই আশঙ্কা রয়েছে। কারণ একটা বড় সংখ্যক মানুষ স্থানান্তরিত হচ্ছেন। পশুর হাটে যাওয়া, কোরবানিতে অংশ নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এই মাত্রা বাড়বে।
এদিকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে এবং শীতকাল পর্যন্ত প্রলম্বিত হলে করোনা পরিস্থিতি জটিল সংকট তৈরি করবে বলে তারা মনে করছেন। তাদের মতে, গ্রামে স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা সীমিত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাতের নাগালের বাইরে। আবার গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনাও কম রয়েছে। পাশাপাশি শীতকালে সামাজিক দূরত্বও কমে আসে। মানুষের সর্দি, কাশিসহ ফ্লুজনিত রোগ এমনিতেই বেশি দেখা দেয়। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৩১ জুলাই সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ২৮ জন এবং আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে দুই হাজার ৭৭২ জন। গত ৩০ জুলাই মারা গেছেন ৪৮ জন এবং আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৬৯৫ জন। এর আগের দিনি প্রাণহানি হয়েছে ৩৫ জনের, আক্রান্ত হন তিন হাজার ৯ জন। ২৮ জুলাই মুত্যু হয় ৩৫ জনের, আক্রান্ত দুই হাজার ৯৬০ জন। আবার হঠাৎ করে মুত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। গত ২৬ জুলাই মুত্যুর সংখ্যা ছিল ৫৪ জন। এর আগের দিন ওই সংখ্যা ছিলো ৩৮ জন। এখন পর্যন্ত মোট মুত্যু হয়েছে তিন হাজার ১১১ জনের, আক্রান্ত দুই লাখ ৩৭ হজার ৬৬১ জন। মৃত্যুর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৮তম আর আক্রান্তের দিক থেকে ১৬তম।
একই সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতেও হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। গত ৩০ জুলাইয়ের তথ্য অনুযায়ী সেখানে একদিনে মারা গেছে ৭৭৫ জন আর আক্রান্ত হয়েছেন ৫২ হাজার ১২৩ জন। গত ২৭ জুলাই আক্রান্ত হয়েছে ৪৯ হাজার ৯৪১ জন এবং মুত্যু ৭০৮ জন। গত ২৯ জুলাই মারা যান ৭৬৮ জন এবং আক্রান্ত ছিলো ৪৮ হাজার ৫৯৩ জন। আক্রান্তের দিক থেকে ভারত বিশ্বে তৃতীয় স্থানে এবং মুত্যুর দিক থেকে ষষ্ঠ স্থানে উঠে এসেছে। ভারতে মোট মৃত্যু ৩৪ হাজার ৯৬৮ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ লাখ ৮৩ হাজার ৭৯২ জন।
দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানেও আক্রান্ত ও মৃত্যু বেড়ে চলেছে। পাকিস্তানে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৫ হাজার ৯২৪ জন এবং আক্রান্ত দুই লাখ ৭৭ হাজার ৪০২ জন।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনার ঝুঁকি এখনো কাটেনি। সামনে আরো ঝুকিঁ আছে। ঈদে মানুষ গ্রামে যাচ্ছে, হাট বাজারে যাচ্ছে। এতে সংক্রমণ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিরোধ করতে না পারলে এটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গড়াতে পারে। শীতকাল পর্যন্ত গড়ানোর যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসলে এই ভাইরাসের ধরন সম্পর্কে ধারণা করাও কঠিন। এখন পর্যন্ত যেসব বলা হচ্ছে সেটা অনুমাণ নির্ভর। তবে আমরা ঝুঁকির মধ্যেই আছি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এমএইচ চৌধুরী লেলিন (লেলিন চৌধুরী) বলেন, জনসংখ্যা অনুপাতে পরীক্ষা হচ্ছে না। পরীক্ষায় ফি নির্ধারণ, ফলাফলের ওপর অনাস্থা দূর করে পর্যাপ্ত পরীক্ষা হলে বাস্তব পরিস্থিতি উঠে আসবে। পরিস্থিতি প্রলম্বিত হওয়ার অবস্থায় চলছে। আমরা নিম্নগামী দেখছি না। ভয় হচ্ছে বেড়ে যাওয়ার। বড় শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্য্যাও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। ইউরোপ, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামে দ্বিতীয় ওয়েব দেখা দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে যে অবস্থা চলছে সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে হাজার হাজার মানুষ মারা যাবে।
আইইডিসিআর’র প্রাক্তন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, পরিস্থিতি একই রকম রয়েছে, গত তিন সপ্তাহ ধরে ওঠানামা করছে। আমাদের দেশে সংক্রমণ ধীর গতি কিন্তু সেটা কমানো যাচ্ছে না। আমাদের জন্য মৃদু লক্ষণযুক্ত রোগী চ্যালেঞ্জ। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ তারা হাসপাতালে যাচ্ছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু মৃদু লক্ষণযুক্তরা চিকিৎসা নিচ্ছেন না, তাদের দ্বারা সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। আসলে বাড়িতে আইসোলেশনে থেকে হবে না, সরকারকে কমিউনিটি আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা না করলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব না। অসর্তকতা পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদী করতে পারে। এতে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হবে। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকায় বাড়ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় দ্বিতীয় বার হানা দিচ্ছে। আমাদের দেশে এখন শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। শহরে তিন গুণ বাড়লে গ্রামে দশ গুণ বাড়ছে।