যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয় না, সেগুলোতে বিদেশনির্ভরতা থাকে৷ তাই বহু পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র এখনো চীন-নির্ভর৷ বাংলাদেশের পণ্যের বাজার বেশি নির্ভরশীল নয়টি দেশের ওপর৷ সেই তালিকায় সবার ওপরের দুটি নাম চীন ও ভারত৷
বাংলাদেশে একজন মানুষের দিন শুরুর পর থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত যেসব পণ্য প্রয়োজন তার প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
গত দশ বছরে বিশ্বের ২১৫টি দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ বা ৪ লাখ কোটি টাকার পণ্যই এসেছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুর এই নয় দেশ থেকে৷
নয় দেশের মধ্যে আবার ৪৩ শতাংশ পণ্যই এসেছে চীন ও ভারত থেকে। ভারত থেকে বেশি আসে ভোগ্যপণ্য, আর চীন থেকে বেশি আসে প্রযুক্তিপণ্য।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন,‘পুরো বিশ্বটাই এখন গ্লোবাল ভিলেজ। কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সবাইকেই কারো না কারো ওপর নির্ভর করতে হয়। এখন আমরা যে পণ্যটা ভালো বানাতে পারি, সেটাই বেশি করে বানাতে হবে। আবার অন্য পণ্য যারা ভালো করে তাদের কাছ থেকে আমাদের আনতে হবে। যেমন ধরেন, ব্রাজিলে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়। এখন আমরা কী তিন ফসলি জমিতে আখ চাষ করবো, নাকি ব্রাজিল থেকে এটা আমদানি করবো? আবার দেখেন এখন আমরা ভারত থেকে গরু আনি না, দেশে গরুর উৎপাদন করতে খরচ বেশি হচ্ছে। এ কারণে গোশতের কেজি ৮০০ টাকা। কিন্তু ভারতের রাজস্থানে হাজার হাজার হেক্টর জমি খালি পড়ে আছে, সেখানে গরু পালতে খরচ কম হয়। এখন আমরা যদি ভারত থেকে গরু আমদানি করি, তাহলে গোশতের দাম কমে যাবে। আবার দেখেন, চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ ভাগ পণ্য চীন থেকে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের তেল থাকলেও তারা কম দামের কারণে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল কেনে।’
বাংলাদেশে একজন মানুষের দিন শুরুর পর থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত যেসব পণ্য প্রয়োজন তার প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ভোগ্যপণ্যের মধ্যে চালে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ এমন একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও প্রতি বছর চালও আমদানি করতে হয়। কয়েকদিন আগে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি পর্যায়ে ৩০ প্রতিষ্ঠানকে ৮৩ হাজার টন সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ৩০ লাখ টন উদ্বৃত্ত হলেও ওই সময়েও বাংলাদেশ প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানি করেছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চালের উৎপাদন বেড়ে পৌঁছে যায় প্রায় ৩ কোটি ৯১ লাখ টনে, যা দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত বাড়ানোয় সহায়ক হয়। তবুও বাংলাদেশকে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি করতে হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি এ বি এম খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমাদের কাছে তো কোনো তথ্য নেই। মন্ত্রণালয় থেকে যে তথ্য আমাদের দেয়া হয় সেটাই আমরা বিশ্বাসযোগ্য মনে করি। আমরাও বুঝতে পারি না, যদি উদ্বৃত্তই হবে তাহলে আমদানি করতে হবে কেন? সরকার যেটা বলে, বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আমদানি, সেটাও আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সরকারের কত ধরনের ব্যবস্থা আছে এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য, সেগুলো প্রয়োগ করলেই তো হয়।’
বাংলাদেশের রফতানির প্রধান খাত তৈরি পোশাক। এই খাতের কাঁচামালও আমদানি করতে হয়। তুলা, সুতা ও কাপড় আসে বিদেশ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য, যা মোট আমদানির ১৮ দশমিক ১১ শতাংশ। ভারত থেকে বর্তমানে তুলা আমদানি হচ্ছে বেশি। গত অর্থবছর দেশটি থেকে মোট আমদানির ৩১ শতাংশ ছিল তুলা, যার জন্য ব্যয় হয়েছে ৪২২ কোটি ডলার। এছাড়া ২২১ কোটি ডলারের শস্য, ৭৭ কোটি ডলারের মোটরযান, ৫৭ কোটি ডলারের চিনি ও চিনিজাতীয় পণ্য, ৫৪ কোটি ডলারের জীবাশ্ম জ্বালানিও আমদানি করা হয় ভারত থেকে।
দুই নারী শ্রমিক পোশাক কারখানায় কাজে ব্যস্তদুই নারী শ্রমিক পোশাক কারখানায় কাজে ব্যস্ত
বাংলাদেশের রফতানির প্রধান খাত তৈরি পোশাক। এই খাতের কাঁচামালও আমদানি করতে হয়।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ২৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়েছে চীন থেকে, যার জন্য খরচ হয়েছে ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলার। চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি। দেশটি থেকে গত অর্থবছর ৪২৫ কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। তারপর সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল তুলা। গত অর্থবছরে চীন থেকে ২২৮ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া ১৯১ কোটি ডলারের ইলেকট্রনিক পণ্য, ১৩৭ কোটি ডলারের নিট কাপড়, ১২২ কোটি ডলারের কৃত্রিম তন্তু আমদানি হয়েছে চীন থেকে।
ভারত ও চীনের নানা ধরনের পণ্যের ওপর বাংলাদেশের এত নির্ভরশীলতার কারণ জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,‘কোনো ব্যবসায়ীকে কেউ তো আর বলেনি আপনি ভারত থেকে আমদানি করেন, চীন থেকে আমদানি করেন। ব্যবসায়ীরা যেখানে সাশ্রয়ী মূল্যে পান, সেখান থেকে আমদানি করেন। এটা অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন আমরা যদি মনে করি, এত আমদানি করবো না, তাহলে চলবে না। আপনাকে প্রয়োজন অনুযায়ী আমদানি করতে হবে। সবকিছুর কাঁচামাল আপনি নিজে উৎপাদন করতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি উৎপাদনে যেতে পারেন, সেটা তো ভালো। আগে যেমন আমরা সাইকেল আমদানি করতাম, এখন দেশে উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি করছি। আবার সিমেন্টও আগে আমদানি করতাম, এখন উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি করছি। এভাবে পারলে তো ভালো।’
কোন ধরনের পণ্যের আমদানি-নির্ভরতা কমছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কসমেটিক্স ও ট্রয়লেট্রিজ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির ভূঁইয়া বলেন,‘কসমেটিক্স জাতীয় পণ্যের আমদানি কমছে। এখন পুরো কসমেটিক্সের ২৫-৩০ ভাগ আমদানি হয়। আগে ৬০ ভাগের বেশি আমদানি হতো। এখন দেশে অনেক ফ্যাক্টরি হয়েছে। তবে এসব পণ্যের কাঁচামাল আসে বাইরে থেকে। এখানেও আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। দেশে কসমেটিক্সের ক্ষেত্রে ভারতের একটা দারুণ প্রভাব রয়েছে। চাইলেই এটা বন্ধ করা যাবে না।’
চিনির বাজার মাঝে মাঝে খুব অস্থির হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে চিনি বিক্রয় সমিতির সহ-সভাপতি হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন,‘আমাদের প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ লাখ টন চিনির চাহিদা আছে। এর মধ্যে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন দেশে উৎপাদিত হয়, বাকিটা আমদানি করতে হয়।‘র সুগার’ বেশি আসে ব্রাজিল থেকে। এখন ভারত থেকেও আসে। আবার ভারত থেকে প্রস্তুতকৃত চিনিও আসে। এখন চিনি চোরাচালানে বেশি আসছে। সীমান্ত এলাকার বাজারগুলোতে ১০০ টাকায় এক কেজি চিনি পাওয়া যায়।’
ভারতে এক কেজি চিনি ৪০ রুপিতে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে কেন প্রতি কেজি চিনি ১৫০ টাকায় কিনতে হয়? এ প্রশ্নের জবাবে হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন,‘৪০ রুপি টাকায় কনভার্ট করলে ৬০ টাকা হয়। এরপর ৪০ থেকে ৪৫ টাকা পড়ে ট্যাক্স। মার্কেটিংসহ বাজারে আনতে কমপক্ষে ১৩০ টাকা পড়ে যায়। এর জন্য ব্যবসায়ীদের দায় দিয়ে লাভ নেই।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর আমদানি বিষয়ক তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের সবচেয়ে বড় উৎস চীন ও ভারত। দেশে শিল্পের মেশিনারিজ ও খাদ্যশস্যের বাজার যত বড় হচ্ছে, পণ্য সরবরাহে এ দুই দেশের অংশীদারত্ব ততই বাড়ছে। পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের বাজারে ৬০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকার মেশিনারিজসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য সরবরাহ করেছিল চীন। ২০২৩ সালে সেখান থেকে এসেছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য। অর্থাৎ, পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশের আমদানি পণ্যের বাজারে চীনের অংশীদারত্ব বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট আমদানি ব্যয়ের বড় একটি অংশই এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, এলপিজি, পুরোনো লোহার টুকরো (রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল), ক্লিংকার (সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল), অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, সার, অপরিশোধিত চিনি, তুলা (বস্ত্র খাতের কাঁচামাল), গম, পাম তেল, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের দখলে।
সূত্র : ডয়েচে ভেলে